ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চতুর মানব পাচারকারী নান্নু মিয়াকে আনা হয়েছে ইন্টারপোলের মাধ্যমে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২ এপ্রিল ২০১৫

চতুর মানব পাচারকারী নান্নু মিয়াকে আনা হয়েছে ইন্টারপোলের মাধ্যমে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে গ্রেফতার হলো আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য নান্নু মিয়া। বাংলাদেশে থাকা নান্নু মিয়ার মানব পাচারকারী চক্রের শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ইরান পুলিশ ও ইন্টারপোলের সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নান্নু মিয়াকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্তত নেই। দুবাই, সিঙ্গাপুর, ইরান, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে লোক নিয়ে তাদের জিম্মি করে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। এরপর নির্যাতিতদের পরিবারের কাছে ফোন করে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, নান্নু মিয়ার বয়স ৫২ বছর। তার বাড়ি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানায়। প্রাথমিকভাবে নান্নু মিয়ারা ৫ ভাই ও এক বোন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পিতামাতা, বোন ও দুই ভাই বাংলাদেশেই থাকেন। অভাবের সংসারে নান্নু মিয়া সিলেটের এক পরিবারে বেড়ে উঠে। প্রায় ৪০ বছর আগে নান্নু মিয়াকে নিয়ে ওই পরিবারটি সবকিছু গুটিয়ে প্রথমে পাকিস্তান চলে যায়। পরে পাকিস্তান থেকে ইরানে চলে যায়। নান্নু মিয়াও তাদের সঙ্গে ইরানে চলে যায়। ইরানে যাওয়ার পর নান্নু মিয়া বেশকিছু দিন ওই পরিবারের সঙ্গেই ছিল। ইরানেই বড় হয়ে উঠে নান্নু মিয়া। সেখানে কাজকর্ম শুরু করে। কাজকর্ম করার সুবাদে নান্নু মিয়া তার দুই ভাইকে তুরস্কে নিয়ে যায়। সেখানেই নান্নু দুই ভাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। নান্নু মিয়া আস্তে আস্তে ইরানে বাংলাদেশীদের নেয়া শুরু করে। নান্নু মিয়া বাংলাদেশ থেকে লোকজন নিয়ে প্রথম দিকে কাজকর্ম দিতে থাকে। এতে নান্নু মিয়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর নান্নু মিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক পাঠাতে তার বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার বোন লোক যোগাড় করে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে নান্নু মিয়ার ইরানে লোক নেয়া। ইরানে লোক নেয়ার কাজ করতে গিয়ে নান্নু মিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের সঙ্গে। এক পর্যায়ে নান্নু মিয়া অতিরিক্ত টাকার লোভে স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ থেকে ইরানে লোক নেয়া শুরু করে। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ওইসব লোকজন নান্নু মিয়ার শরণাপন্ন হন। এ সময় নান্নু মিয়া তাদের ভাল কাজ দেয়ার প্রলোভন দিয়ে নিজেদের গোপন আস্তানায় রেখে দেয়। নান্নু মিয়ার সঙ্গে ১০টি আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সরাসরি যুক্ত। নান্নু মিয়ার অন্য মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। নির্যাতিতদের দিয়ে তাদের পরিবারের কাছে ফোন করানো হতো। মুক্তিপণ হিসেবে ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত একেক জনের পরিবারের কাছ থেকে আদায় করত। নান্নু মিয়া ইরানের নাগরিকত্ব লাভ করায় তার দেশে ফেরার কোন ভয় ছিল না। এ কারণে সে বেপরোয়াভাবে মানুষ জিম্মি করে টাকা আদায় করছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ২০১৩ সালের প্রথম দিকে। একজন ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ইরান থেকে বাংলাদেশে ফিরে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার তদন্তভার বহু হাত ঘুরে চলে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্তবিভাগের (সিআইডি) মালিবাগ সদর দফতরের অর্গানাইজস ক্রাইম বিভাগের কাছে। শুরু হয় গুরুত্বের সঙ্গে মামলাটির তদন্ত। সিআইডি সূত্র বলছে, নান্নু মিয়ার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ রয়েছে। সবই একই ধরনের। অভিযোগগুলোতে বলা হয়েছে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের পাশাপাশি অনেককেই নান্নু মিয়া ও আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারীরা দুবাই, সিঙ্গাপুর, আবুধাবী, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে দিয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১৬০ জনকে এভাবেই ইরানে নিয়ে মুক্তিপণ ও পাচার করে দেয়া হয়েছে। এ কাজে নান্নু মিয়ার বোনও সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন সময় কাজ করেছে। বাংলাদেশে নান্নু মিয়ার শতাধিক জনের একটি মানব পাচারকারী চক্র রয়েছে। যারা বাংলাদেশ থেকে ইরানে লোক পাঠিয়ে থাকে। এর মধ্যে নান্নু মিয়ার বোনসহ হালনাগাদ ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। বাংলাদেশে থাকা নান্নু মিয়ার সহযোগীরা জিম্মি থাকা পরিবারের কাছ থেকে বিকাশ বা অন্য মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা আদায় করত। সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আব্দুল্লাহেল বাকী জনকণ্ঠকে জানান, ফেরত আসা যুবকের মামলার তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলে। বিষয়টি সিআইডির তরফ থেকে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে ২০১৩ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল মারফত ইরান পুলিশকে জানানো হয়। ইরান পুলিশ অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্তে নান্নু মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপর ইরান পুলিশ নান্নু মিয়াকে ২০১৩ সলের শেষ দিকে গ্রেফতার করে। তাকে ইরানের কারাগারে রাখা হয়। ইতোমধ্যেই ইন্টারপোলের মাধ্যমে নান্নু মিয়ার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়ে ইরান পুলিশের সঙ্গে সিআইডির যোগাযোগ হয়। নানা কারণে সিআইডির পক্ষে ইরান গিয়ে নান্নু মিয়াকে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ইন্টারপোল ও ইরান পুলিশের সঙ্গে সিআইডি পুলিশ যোগাযোগ করে। সিআইডি পুলিশ নান্নু মিয়াকে শুধু বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে ইরান পুলিশ ও ইন্টারপোলকে অনুরোধ করা হয়। তারা যথারীতি নান্নু মিয়াকে বাংলাদেশগামী বিমানে তুলে দেয়। পাশাপাশি নান্নু মিয়া কোন বিমানে আসছে, কখন, কোথায়, কোন বিমানবন্দরে নামবে, সে সব দেশের পুলিশকে তার ওপর নজরদারি করতে ইন্টারপোল সহায়তা করে। অবশেষে নান্নু মিয়াকে ইরান পুলিশ ও ইন্টারপোল গত ৩০ মার্চ সফলভাবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। এরপর বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও সিআইডি নান্নু মিয়াকে গ্রেফতার করে। ক্ষতিগ্রস্তদের তরফ থেকে নান্নু মিয়ার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের সহযোগীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
×