ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধ হরতাল এখন সন্ত্রাসীর সাঙ্কেতিক শব্দ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২ এপ্রিল ২০১৫

অবরোধ হরতাল এখন সন্ত্রাসীর সাঙ্কেতিক শব্দ

খালেদা জানেন, দেশে কোন হরতাল অবরোধ হচ্ছে না। তারপরেও তিনি নিয়মিত হরতাল ও অবরোধ ঘোষণা করে যাচ্ছেন। তিনি জানেন, গুলশান অফিসে তিন মাস অবস্থান করেও আন্দোলনে কোন সফলতা পাননি। তারপরেও তিনি সেখানে অবস্থান করছেন। এ কি কেবলই উদ্দেশ্যহীন এক পথচলা? খালেদা এখন আর কোন নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতা নন, তাই তাঁর কোন কাজ রাজনৈতিক নৈতিকতার বিচারে মাপলে ভুল হবে। খালেদা এখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক তথাকথিত ইসলামিক জঙ্গীদের নেতা। তার প্রতিটি কাজ আন্তর্জাতিক জঙ্গীদের কাজের সঙ্গে মিলিয়ে হিসাব করা প্রয়োজন। এ কাজটি করা আমাদের মতো সাংবাদিকদের পক্ষেও সম্ভব নয়। এ কাজের জন্যে যোগ্য সেই সব পশ্চিমা সাংবাদিক যারা দীর্ঘ সময় আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের যাবতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন ও তাদের নেতাদের কাজের ওপর রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে দেখা করেছেন ও সাক্ষাতকার নিতে পেরেছেন ওই সব জঙ্গী নেতার। কেউ কেউ পরবর্তীতে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করেছেন, এই তথাকথিত ইসলামিক জঙ্গীদের ওপর। জঙ্গী সম্পর্কে আমাদের দৌড় হচ্ছে এঁদের বিভিন্ন সময়ের রিপোর্ট, বিশ্লেষণ ও গবেষণার কাজগুলো পড়া। বড়জোর কারও কারও সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ মেলা। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে মাঝে মাঝে কিছু ইন্টারেকশান হয়, এই যা। তাই বর্তমানে খালেদা কী করতে চাচ্ছেন বাংলাদেশে এ বিষয়টি আমাদের পক্ষে বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিন। খালেদা এখন আর কোন একক ব্যক্তি নন, তিনি এখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গীদের মূল প্রতিনিধি। তিনি পরিচালিত হচ্ছেন খুব বড়মাপের একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গী চক্র দ্বারা। এই চক্র আর্থিকভাবে অসম্ভব শক্তিশালী। সারা বিশ্বের এই জঙ্গী চক্র বৈধ ও অবৈধ নানান ব্যবসায়ে জড়িত। বিশেষ করে মাদক চোরাচালান ও অস্ত্র চোরাচালান এদের সব থেকে বড় ব্যবসা। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল থেকে সব কিছুই এরা করতে চায়, কিন্তু অর্থের জন্যে। অন্য কোন কারণে নয়। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে এরা জনবল সংগ্রহ করে, অন্ধ অনুসারী গড়ে তোলে কিন্তু এদের মূল লক্ষ্য অঢেল অর্থের মালিক হওয়া। লাদেনের কন্ট্রাকটরী বিজনেসের চেয়ে কিন্তু অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানে শতগুণ বেশি আয় ছিল। খালেদারও সম্পদের পরিমাণ ব্রিটেনের রানীর থেকেও বেশি। বিশ্বের শীর্ষ ধনী মহিলাদের ভেতর তাঁর অবস্থান তিন নাম্বারে। কিছু কিছু উদাহরণ দেয়া অনেকটা নিষ্ঠুরতার পরিচয়, তার পরেও নির্মোহ বিশ্লেষণের জন্যে অনেক সময় এগুলোর প্রয়োজন পড়ে। একটা ছোট্ট বিষয় লক্ষ্য করা যেতে পারে, জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ যেদিন ঢাকায় আনা হয়েছিল ওই দিন টেলিভিশনে হাজার হাজার লোক দেখেছিলেন, খালেদা কফিনে রাখা জিয়ার মুখ দেখতে গিয়েছিলেন। সেদিনের কথা নিশ্চয়ই যারা দেখেছিলেন, তারা মনে করতে পারবেন, সেদিন খালেদার বেশও আলু থালু ছিল না। তার চোখের কোনায় এক ফোঁটা পানিও ছিল না। আবার মাত্র কিছু দিন আগের ঘটনা। কোকোর মৃতদেহ গুলশান অফিসের সামনে আনা হয়। ছেলের মরদেহ আসার পনেরো মিনিট পরে মা নামেন! ছেলের মুখে হাত দিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকান। চোখে এক ফোঁটা পানি ছিল না। অথচ আমরা প্রতিদিন টেলিভিশনের পাতায় কোন না কোন সন্তানের বা আপনজনের মৃতের সচিত্র সচল খবর দেখি। সেখানে স্বজনের আহাজারি, তাদের আলু থালু বেশ কি আমাদের চোখে পড়ে না? বলতে পারেন, ওই সব সাধারণ মানুষের থেকে খালেদা অনেক বেশি নিজেকে সংযত রাখতে সক্ষম। তাই অমনটি ঘটে। তবে সকলের নিশ্চয়ই খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হওয়ার দিনটি মনে আছে। সেদিন কি দেশের মানুষ দেখেনি তার শোকাহত চেহারা! তাঁর পোশাক আলু থালু। তাঁর দুচোখ বেয়ে ঝরছে পানির ধারা। সেই কান্নার ছবি যে কোন মুহূর্তে যে কেউ গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন। এই একটি উদাহরণ থেকে কি বোঝা যায় না সম্পদ বা অর্থ তাঁর কাছে কত বড়? স্বামী বা সন্তান হারানোর শোকের থেকে একটি বাড়ি হারানোর শোক তাঁর কাছে কত সহস্রগুণ বেশি। তাই তিনি যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে জঙ্গীদের হাতে দেশ ছেড়ে দেন, তাঁর ছেলে তারেক তখন জঙ্গীদের নেতৃত্ব নেয় হাওয়া ভবনে বসে এর মূল কারণ কিন্তু অর্থ উপার্জন। বাংলাদেশের মতো একটি সুবিধাজনক জঙ্গী ট্রানজিট রুটের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে আন্তর্জাতিক জঙ্গীরা সব সময়ই অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করবে। আর এ কাজে তারা খালেদাকে যথার্থ নেতা হিসাবে পেয়েছে। তাই খালেদা এখন যে কাজ করছে এগুলোকে সহজভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। খালেদা জানেন, এখন তাঁর ডাকে কোন অবরোধ ও হরতাল হচ্ছে না। তারপরেও তিনি ডাকছেন কেন? তিনি এই ঘোষণা দিচ্ছেন অনেক কারণে। যারা জঙ্গী এক্সপার্ট তারা বিশ্লেষণ করে হয়ত সব কারণ খুঁজে না পেলেও অনেক কারণ বের করতে পারবেন। তবে জঙ্গীদের কাজের ধরন থেকে বোঝা যায়, খালেদা জিয়ার এই হরতাল অবরোধের ঘোষণা দেয়ার মূল কারণ, সারাদেশে তার যে জঙ্গীরা আছে তাদের কাছে একটি মেসেজ পৌঁছে দেয়া। মেসেজটি হচ্ছে, তোমরা যে যেখানে সুযোগ পাও সেখানেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম করো। অর্থাৎ পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ খুন করো, বোমা মেরে মানুষ খুন করো, চাপাতি দিয়ে মানুষ খুন করো আর পারলে সরকারী সম্পদ ধ্বংস করো। হরতাল-অবরোধ তাই এখন তাদের এ কাজের একটি সাঙ্কেতিক শব্দ। এই হরতাল-অবরোধ ঘোষণা মানেই সন্ত্রাসীদের বা জঙ্গীদের প্রতি নির্দেশ তোমরা জঙ্গী কর্মকা- চালিয়ে যাও। আর খালেদা একটি বিশাল বহর নিয়ে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে বসে আছে মূলত সারাদেশে এই জঙ্গীদের কার্য পরিচালনার জন্যে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে সেন্টার রাইট নেতা যারা তাঁর দলে ছিলেন তারা এখন অনেকখানি নিষ্ক্রিয়। চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদের সিটি নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়া একটি বড় সিগন্যাল। বিষয়টি অবশ্যই বিশ্লেষণের বা চিন্তার। কেন, আমীর খসরু মাহমুদকে সিটি নির্বাচন প্রার্থী হতে বললেও তিনি সে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না? আমীর খসরু মাহমুদ একজন ডানপন্থী রাজনীতিক। কিন্তু তিনি জঙ্গী নন। খালেদা জিয়া ও তার একটি কথোপকথনের অডিও প্রকাশ হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, খালেদা তাঁকে ধমকাচ্ছেন, তিনি যেন ডাঃ শাহদাতকে যে সন্ত্রাসী কাজগুলো করতে খালেদা নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোতে বাধা না দেন। এখান থেকে বোঝা যায়, আমীর খসরু মাহমুদ সবার আগে বুঝতে পেরেছেন, সিটি নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ মূলত জামায়াত-বিএনপির একটি সন্ত্রাসী কাজ করার সুযোগ করে দেবার কাজে ব্যবহৃত হওয়া। তারা চাচ্ছে, সিটি নির্বাচনটিকে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বড় ধরনের কোন সন্ত্রাসী কাজের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা? আমীর খসরু মাহমুদ নিজে এই সন্ত্রাসী কাজের অংশ হতে চান না বলেই কিন্তু তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে সকলে মনে করেছিল চট্টগ্রামে ডাঃ শাহদাতকে মনোনয়ন দেয়া হবে। কিন্তু তাও দেয়া হয়নি। এরও পেছনে কারণ আছে। ডাঃ শাহদাতকে সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন দিলেই সরকার বা প্রশাসন প্রথমেই সজাগ হবে, জঙ্গীরা সংগঠিত হচ্ছে এবং তারা যে কোন মুহূর্তে যে কোন ধরনের বড় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই তারা মঞ্জুরকে মনোনয়ন দিয়েছে। আর তার পাশে থাকতে বাধ্য করেছে আমীর খসরু মাহমুদকে। প্রার্থী হিসেবে মঞ্জুর দুর্বল এ সত্য বিএনপি ও জামায়াত জানে। কারণ, গত পাঁচ বছরে তিনি একজন ব্যর্থ মেয়র। তাকে এভাবে প্রার্থী করে, আমীর খসরু মাহমুদকে পাশে রেখে ডাঃ শাহদাতকে পিছনে ঠেলে দেয়া কিন্তু খুবই পরিকল্পিত বিষয়। খালেদা ও জামায়াত মনে করে, সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা ঢাকার থেকে চট্টগ্রামে বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাতে পারবে। চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিবেশ জঙ্গীদেরকে সে সুযোগ দেয়। তাছাড়া তারা দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় সুসংগঠিত। তাই তারা এই সিটি নির্বাচন কেন্দ্র করে জঙ্গীদেরকে যে সংগঠিত করবে, ফটিকছড়ির মতো নানান ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর যে নেতৃত্ব দিতে পারবে সেই শাহদাতকে কিন্তু তারা পেছনেই রেখেছে। যাতে সরকার ও প্রশাসনের চোখ তার দিকে না পড়ে। চট্টগ্রামের মতো ঢাকায়ও তারা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানোর জন্যে সিটি নির্বাচনকে কাজে লাগাবে। অবস্থাদৃষ্টে বা যতটুকু খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, ঢাকায় যেহেতু প্রশাসনের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি বেশি থাকবে তাই এখানে তারা নারী সন্ত্রাসীদের ব্যবহারের ওপর জোর দেবে। তারা রাজশাহী, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে জামায়াত, জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের নারী সন্ত্রাসীদের ঢাকায় জড়ো করা শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচনের প্রচারের কাজে লাগানো হচ্ছে বলে এই সব নারী জঙ্গীদের একটি আবরণ দিয়ে রাখা হবে। এদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এমনকি নির্বাচনী কেন্দ্রকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর চেষ্টা তারা করবে। খালেদা গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে যে কাজ করছেন, তাতে সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে মুখ রক্ষা করে আন্দোলন থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছেন- এমন যারা বলছেন, তারা এখনও খালেদার গত তিন মাসের কর্মকাণ্ডকে বুঝতে পারেননি। আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতাও এমন কথা বলছেন। তবে কিছুটা সত্যের আভাস দিয়েছেন মঙ্গলবারের মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সৈয়দ আশরাফ। তিনি বলেছেন, খালেদা নির্বাচনও চান না তত্ত্বাবধায়কও চান না। তিনি একাত্তর সালেও পাকিস্তানীদের সঙ্গে ছিলেন এখনও তাদের সঙ্গে আছেন। আর প্রধানমন্ত্রী তো অনেক আগেই বলে দিয়েছেন, তিনি গুলশানে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রীকে খুন করার জন্যে। তাঁকে খুন না করে তিনি ওই বাড়ি থেকে বের হবেন না। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের জেনারেল সেক্রেটারি যখন খালেদার গতিপথ সঠিক চিহ্নিত করেছেন তখন দেশের মানুষ আশা করতে পারে, এই সন্ত্রাসীদের রুখে দেবার জন্যে সরকার সর্বোচ্চ করবে। যদিও এখানে সর্ষের ভেতর অনেক ভূত আছে। অনেক সফট ওয়ারে সমস্যা আছে। তারপরেও সরকারকে যেমন ঢাকার নারী জঙ্গী থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের আইএস জঙ্গী সব দমন করতে হবে দেশকে রক্ষার জন্যে। পাশাপাশি দেশের বিচার বিভাগের শুধু নয়, আইন অঙ্গনে যারা আছেন তাদেরকে এখন সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে হবে পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে। কারণ, গত তিন মাসে রাজনৈতিক দলের বৈধতার আড়ালে থেকে বিএনপি যে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়েছে এর পরে দলটি আইনত দেশের বৈধ রাজনৈতিক দল থাকতে পারে কি? পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন এ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে যত দেরি করবে ততই দেশ ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। [email protected]
×