ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রদীপ মালাকার

অভিজিত হত্যাকাণ্ড ও কয়েকটি প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১ এপ্রিল ২০১৫

অভিজিত হত্যাকাণ্ড ও কয়েকটি প্রশ্ন

মার্চের ৫ তারিখ। নিউইয়র্ক সিটিসহ আমেরিকাতে ব্যাপক সারাদিন স্নো পড়ে। এই জন্য রাস্তা-ঘাটের অবস্থাও ছিল খারাপ। অলস সময় না কাটিয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পুরনো কর্মস্থল খ্রিস্টফার কলম্বাস হাই স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়া মাত্রই মিস্টার মাইকসহ পুরনো কয়েক শিক্ষক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। মিস্টার মাইক তাঁর ক্লাস শেষ করে আমাকে নিয়ে কাফেটারিয়াতে বসেন। কফির অর্ডার দিয়ে অভিজিতের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলে রাখা ভাল, মিস্টার মাইক একজন ইতিহাসের শিক্ষকই নন, মেইনস্ট্রিম রাজনীতি তথা রিপাবলিকান পার্টিরও একজন সক্রিয় কর্মী এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিরও খোঁজখবর রাখেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ব্লগার অভিজিত তো তেমন বিখ্যাত ছিলেন না, তবে কেন তাঁকে হত্যা করা হলো? এর আগে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ কিংবা ব্লগার রাজীব আহমেদকেও একইভাবে হত্যা করেছিল জঙ্গীরা। তখন দেশীয়ভাবে হত্যার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আন্দোলন, প্রতিবাদ হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এবার কেন অভিজিতের বেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাল? তবে কি অভিজিত আমেরিকার নাগরিক হওয়ার কারণে? সংক্ষেপে অভিজিতের পরিচয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। বেশ কিছু সময় ডক্টর অভিজিত প্রকৌশল (বুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। অভিজিত ‘মুক্তমনা ব্লগের’ প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর ব্লগে তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তা বিষয়ে লেখালেখি করতেন যা ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের পছন্দ হতো না। তারা যুক্তি, মেধা দিয়ে তার লেখা মোকাবেলার পরিবর্তে দুই বছর পূর্ব থেকেই প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গী সংগঠন নাছিরুল্লা বাংলা টিম সেভেনের সক্রিয় সদস্য শফিউর রহমান ফারাবীসহ অনেকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিজিত স্ত্রী রাফিদা আহমেদ (বন্যা)কে নিয়ে ঢাকায় আসেন তাঁর দুইটি বই প্রকাশ উপলক্ষে যোগ দেয়ার জন্য। লেখক হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন, বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দীপ, চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকি, গোপীবাগের সিক্স মার্ডার একই সূত্রেগাঁথা। ভিন্ন মতাদর্শ, স্বাধীন মত প্রকাশের কারণেই তাদের একই কায়দায় হত্যা করা হয়। অভিজিৎ মার্কিন নাগরিক বলে কথা নয়, অভিজিত তো কানাডা বা ব্রিটেনের নাগরিক নয়, তারা কেন তীব্রভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাল কিংবা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক দেশে গিয়ে জমি-জমাসংক্রান্ত বিষয়ে বা প্রতিপক্ষের হাতে গুম, খুন ও নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে আমেরিকা এগিয়ে আসেনি। এবার কেন এই বিশ্ব মোড়ল ও তাদের সহযোগীরা এগিয়ে এলো। বিষয়টি আসলে অন্য জায়গায়। অভিজিতের হত্যাকাণ্ডটি তারা বিছিন্ন ঘটনা বা ব্যক্তি হিসেবে নেয়নি, তারা নিয়েছে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা তথা সভ্যতার ওপর আঘাত হিসেবে। এই জন্যই প্যারিসের চার্লি হেবদো হত্যাকাণ্ড, ডেনমার্কের সিনেগগ ও বোস্টন হামলার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পায়। আর বাংলাদেশের বেলায় অভিজিত হত্যাকাণ্ডটি ছিল গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত। এ ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বাম দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন প্রতিবাদ, মানববন্ধনের মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। শুধু কি তাই, অভিজিত হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করে অভিজিতের পিতা অধ্যাপক অজয় রায় ও তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানান এবং চারমন্ত্রীও অজয় রায়ের বাসায় যান ও সমবেদনা জানান অথচ এই খবরটুকু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখানো হলো না। পুরোপুরি জঙ্গী দমনে সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই সাফল্যের দাবি করে থাকেন অথচ কোন না কোন সপ্তাহে র‌্যাব, পুলিশের হাতে জঙ্গী ধরার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠে কয়েকটি রিপোর্টেও দেখা যায়, ১৭ মার্চ লালমনিরহাটে জামায়াতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ১৩ জঙ্গী গ্রেফতার, ২১ মার্চ সেনা, এসএসএফ ও জঙ্গিদের ট্রেনিং দেয়ার ভিডিও উদ্ধার, উখিয়ার গহীন পাহাড়ী অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, জিহাদী বইসহ জঙ্গীদের গ্রেফতার এবং এ লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ খবর, জামা আতুল মুজাহিদিন (জেএমবি) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখার প্রধান এরশাদ গ্রেফতার। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের নির্দেশে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের কথা অস্ত্র-বোমাসহ গ্রেফতার হওয়া এরশাদ পুলিশের কাছে স্বীকার করে অথচ এ সকল ভয়ঙ্কর জঙ্গীর কাছ থেকে পুলিশের স্বীকারোক্তি আদায়ে যে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তা জঙ্গী দমনে বড় অন্তরায়। জোট আমলে আমরা দেখেছি, র‌্যাব জঙ্গীদের ধরে পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে, জঙ্গীরা আল্লাহু, আল্লাহু জিগির তুলে পুলিশকে দুর্বল করে দিয়েছে। আর এভাবেই পুলিশের দুর্বল চার্জশীটের কারণে হাজার হাজার জঙ্গী বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি জামায়াতের এক নেতা দম্ভ করে বলেন, আমাদের ৭০ ভাগ নেতাকর্মী জেল থেকে বেরিয়ে আসছে, বাকি ৩০ ভাগও ইনশাআল্লাহ অচিরেই বেরিয়ে আসবে। কাজেই জামায়াত নেতার দম্ভ করার স্থানটি কোথায়, তা কারও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এবারও এরশাদসহ বিভিন্ন সময়ে ধৃত জঙ্গীদের মিডিয়া সেলে এনে সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফিং কালে এদের দেখে অন্যদের সঙ্গে আমারও মনে হচ্ছিল- এরা যেন দেশের ভিআইপি সন্ত্রাসী কিংবা একই দুর্বল চার্জশীট বা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে গত ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব আহমেদ শোভন হত্যার অন্যতম আসামি শফিউর রহমান ফারাবী জামিনে বেরিয়ে এসেই ফেসবুকে ডক্টর অভিজিত রায়কে হত্যার হুমকি দেয়। অভিজিতকে হত্যার হুমকি প্রদানকারী শফিউর রহমান ফারাবী পুনরায় গ্রেফতার হওয়া ও রিমান্ডের পর টিভির পর্দায় ফারাবীকে বিচলিত বা অনুশোচনা তো নয়ই বরং উপস্থিত হাস্যোজ্জ্বল পুলিশকেই তার প্রতি সদয় মনে হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, শুধু জঙ্গী দমনে আলাদা একটি বাহিনী গঠন করা হবে। এটি ভাল খবর। যদি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আধুনিক উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ একটি দেশপ্রেমিক বাহিনী গড়ে তোলা যায়, তাহলেই জঙ্গী দমন সম্ভব। আর তা না হলে অভিজিত গং এভাবেই বার বার মারা যাবে, আর ফারাবী গংও বার বার বেরিয়ে আসবে। পরিশেষে, সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল কবিরের উক্তিটি উল্লেখ করতে চাই, ভবিষতে জাতি আর কোন বিচারকের হাতে অভিজিত গংয়ের রক্তের দাগ আর দেখতে চায় না। লেখক : প্রাবন্ধিক
×