ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক ক্রিকেট ঋষির বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১ এপ্রিল ২০১৫

এক ক্রিকেট ঋষির বিদায়

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া সাবেক অধিনায়ক মার্টিন ক্রো বলেছিলেন নিউজিল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন দেখার পর মুহূর্তে মরণ হলেও আফসোস থাকবে না তার। সেনাপতি ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম ট্রফিটা জিততে চেয়েছিলেন ভেট্টোরির জন্য। কোনটাই হলো না। আসর জুড়ে অবিশ্বাস্য-অপরাজেয় কিউইরা থামল চূড়ান্ত মঞ্চে এসে, শিরোপার একেবারে নিঃশ্বাস ছোঁয়া দূরত্বে। ক্রিকেটের ভাগ্য বিধাতা বুঝি এমনইÑ যিনি এক অস্ট্রেলিয়াকে পঞ্চমবারের মতো বসান সেরার আসনে, আবার সব ‘হাহাকার’ উপেক্ষা করে ‘শূন্য’ হাতে ফিরিয়ে দেন ক্রিকেটের বড় কোন সাধককে। জীবনের ৩৬ বসন্তের ১৮টিই কাটিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, ক্লাব-ঘরোয়া মিলিয়ে সেটি আরও বেশি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ক্রিকেটকে করেছেন আলোকিত, স্পিন-ভেল্কিতে গড়েছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড, শিরোপা ছোঁয়ার কষ্ট নিয়ে বিদায় নিতে হলো ক্রিকেটের ধ্যানমগ্ন সেই ‘ঋষি’ ড্যানিয়েল লুকা ভেট্টোরিকে। তাতে কী? সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ভক্তদের ভালবাসা। রবিবার মেলবোর্নে ফাইনাল খেলে কাল বুধবার দেশে ফিরেছে রানার্সআপ নিউজিলান্ড। বিমানবন্দরে মানুষের ঢল। রাগবি-গল্ফের দেশে ক্রিকেটারদের বরণ করে নিতে ফুলের মালা-তোড়ন হাতে ভক্তরা, যেখানে ‘মধ্যমণি’ ভেট্টোরি। শিরোপা ছোঁয়া হয়নি তো কী হয়েছে? আবেগ ভরা কণ্ঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে ‘গুডবাই’ জানাতে ভক্তদের ভালবাসাকেই বেছে নিলেন কিউই মহাতারকা। ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালই হয়ে থাকল ভেট্টোরির শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এরপর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের (এনজেডসি) অফিসিয়াল সাইট থেকে নিশ্চিত করা হয় বিদায়ের খবর। দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিল কিউইরা। কাল অকল্যান্ড বিমানবন্দরে নেমেই ভক্ত-সমর্থকদের ভালবাসায় সিক্ত হন ম্যাককুলামরা। সেখানেই বিদায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা দিয়ে দেন কিউই গ্রেট স্পিনার। ‘জীবনের শেষ ম্যাচ হিসেবে বিশ্বকাপের ‘ফাইনাল’ খেলাটা দারুণ বিষয়। ট্রফি জিততে পারলে আরও ভাল লাগত। দলের সঙ্গে ছয় সপ্তাহ ছিল অসাধারণ।’ বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে বলেন ভেট্টোরি। আর এনজেডসি তাদের অফিসিয়াল টুইটার পেজে উল্লেখ করে, ‘ড্যান জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বকাপের ফাইনালেই ব্ল্যাক ক্যাপস পরে শেষ ম্যাচটি খেলে ফেলেছে সে।’ কেবল বলার জন্য বলা নয়, আক্ষরিকই জীবনের অর্ধেকেরেও বেশি সময় ক্রিকেটকে দিয়েছেন। ১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওয়েলিংটনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখেন ১৮ বছর বয়সী ভেট্টোরি। ঠিক দেড় যুগের মাথায় এসে শেষটা করলেন ওয়ানডে দিয়ে। ২৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে বিশ্বকাপ ফাইনালই হয়ে থাকল শেষ-মঞ্চ। অভিজাত টেস্ট অঙ্গনকে বিদায় জানিয়েছিলেন আগেই। গত বছর নবেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভেট্টোরির অবসর ম্যাচে জয় পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দলের অধিনায়কের গুরুভারও বহন করেছেন এক সময়। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট ও ওয়ানডে খেলার রেকর্ড তারই দখলে। এবারসহ খেললেন মোট পাঁচ-পাঁচটি বিশ্বকাপ। ১৯৯৭-এ ক্যারিয়ার শুরুর পর ১৯৯৯ বিশ্বকাপের দলে অবশ্য সুযোগ পাননি। তবে ২০০৩ থেকে ঘরের মটিতে ১১তম আসর পর্যন্ত ছিলেন অপরিহার্য সদস্য হয়ে। একের পর এক চোট আর অসুস্থতায় বার বার ছিটকে গেছেন মাঠের বাইরে। একাধিকবার যেতে হয়েছে অপারেশনের টেবিলে। শেষ দিকে এসে ফর্মটাও ঠিক নিজের মতো ছিল না। এতকিছুর পরও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে বিদায় নেয়াটা ভেট্টোরির জন্য কম প্রাপ্তি নয়। তবে বিশ্বশ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ভেট্টোরির থাকাটা মোটেই টেনে-হিঁচড়ে থাকার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। স্পিন আক্রমণের পুরোধা হয়ে দলকে ফাইনালে তুলে অনার অন্যতম কারিগর তিনি। ৯ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে আসরের পঞ্চম সর্বাধিক শিকারি তিনি। স্পিনারদের মধ্যে সবার ওপরে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের কথা নিশ্চই ভুলে যাননি ক্রিকেটপ্রেমীরা। ব্যাট হাতে অসময়ে ঝড় তোলা জোনাথন কার্টার ও জেসন হোল্ডারকে ফিরিয়ে দিয়ে ক্যারিবীয়দের কবরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই জানেন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন স্পিনারদের জন্য কতটা কঠিন। অথচ প্রতিটি ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলে নিয়ে দলকে সাহায্য করছেন বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার। কেবল বোলিংই নয়, টেল-এন্ডে ব্যাট হাতেও দুর্দান্ত। ভেট্টোরির অপরাজিত ১৬ রানের সৌজন্যেই গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে নাটকীয় জয় পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড। ১১৩ টেস্টে ৩৬২ ও ২৯৫ ওয়ানডেতে শিকার সংখ্যা ৩০৫টিÑ যথাক্রমে ৪৫৩১ ও ২২৫৩ রান ভেট্টোরিকে বসিয়েছে অলরাউন্ডারের আসনে। টেস্টে সেঞ্চুরি রয়েছে ৬টি। সাদা পোশাকে ৪০০০-এর বেশি রান, একই সঙ্গে ৩০০-এর বেশি উইকেট পাওয়া ইতিহাসের তিন গ্রেট অলরাউন্ডারের একজন ভেট্টোরি। অপর দু’জন কপিল দেব ও ইয়ান বোথাম। ‘ভেট্টোরির অভাব পূরণ হওয়া কঠিন। আমরা সর্বকালের সেরা একজনকে হারালাম। ড্যানির অভাবটা নিউজিল্যান্ডকে বেশ কিছুদিনই তাড়িয়ে বেড়াবে।’ বলেন অধিনায়ক ম্যাককুলাম। কিউইরা মিস করবেন তাদের কিংবদন্তি ভেট্টোরিকে, আর বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন মিস করবে এক ক্রিকেট ঋষিকে।
×