ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চসিক নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর হলফনামার চিত্র

মনজুর আলমের ঋণ ৩৬০ কোটি, নাছিরের ৮ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩১ মার্চ ২০১৫

মনজুর আলমের ঋণ ৩৬০ কোটি, নাছিরের ৮ কোটি টাকা

মোয়াজ্জমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত দুই প্রার্থী যথাক্রমে আ জ ম নাছির উদ্দিন ও এম মনজুর আলমের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকবে। যদিও জাতীয় পার্টিসহ নামসর্বস্ব দুয়েকটি দল এবং স্বতন্ত্র মিলে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১৩ জন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু থেকে বরাবরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর মধ্যে ভোটের মূল লড়াই অব্যাহত রয়েছে। তৃতীয় কোন দল বা শক্তি এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বশেষ ২০১০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আসতে পারেনি। এবারও আসার কোন সম্ভাবনা যে নেই তা নিশ্চিত। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দিন ও বিএনপির এম মনজুর আলমের মধ্যে মূল লড়াই নিয়ে সকল জল্পনা-কল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিনে এ দুই প্রার্থী তাদের যে মনোয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাতে সংযুক্ত হলফনামায় যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যায়, এম মনজুর আলম ১৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ৩৬০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন ৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন। এ সব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭২৪ টাকা। তবে তাদের এ সব ঋণখেলাপী নয়। এছাড়া হলফনামায় দু’জনের নগদ টাকা ও অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, মনজুর আলমের নগদ টাকা রয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩ হাজার ৬৪৫ টাকা, স্ত্রীর নামে রয়েছে ১৯ লাখ ৮০ হাজার ৬৪০ টাকা। মনজুর আলমের নামে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে ২৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭ হাজার ৯৮৩ টাকার। স্ত্রীর নামে রয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ২৫ হাজার ৭০২ টাকার বন্ড, ঋণপত্র ও শেয়ার। মনজুর আলমের ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার একটি গাড়ি রয়েছে। স্বর্ণ ও বিভিন্ন মূল্যবান ধাতুর অলঙ্কার রয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে রয়েছে ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকার স্বর্ণালঙ্কার। তাদের ইলেকট্রনিকস সামগ্রী রয়েছে ২ লাখ টাকার। আর আসবাবপত্র রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৫শ’ টাকার। স্ত্রীর আসবাবপত্র রয়েছে ৩ হাজার টাকার। তার নামে কোন মামলা নেই। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিনের হলফনামায় বলা হয়েছে তার নগদ টাকা রয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯০ টাকা ও স্ত্রীর আছে ৪৫ হাজার ৫৭৯ টাকা। নিজের নামে ব্যাংকে আছে ৯১ হাজার ৩৬ টাকা এবং স্ত্রীর নামে জমা আছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৩ টাকা। ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৯৫ হাজার ৪৯৮ টাকা। মোট শেয়ার রয়েছে ৩০ লাখ ৪২ হাজার ১৯৮ টাকার। জীবনবীমা পলিসি বাবদ জমা এবং ডিপিএস আছে ৪১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৮ টাকা। স্ত্রীর নামে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে ৩৪ লাখ টাকার। স্ত্রীর এফডিআর আছে ১২ লাখ ৫৪ হাজার ৩২০ টাকা। তার ব্যবহৃত জিপগাড়ি ও ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিকস সামগ্রী রয়েছে। স্ত্রীর নামে ইলেকট্রনিকস সামগ্রী রয়েছে ৪০ হাজার টাকার। নিজের নামে ঢাকায় একটি প্লট এবং চট্টগ্রাম শহরে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়ির ৬ ভাগের একভাগের মালিকানা রয়েছে। দুই প্রার্থীর প্রদত্ত হলফনামা অনুযায়ী মনজুর আলমের তুলনায় আ জ ম নাছিরের আয় বেশি। ভোটে মুখোমুখি মনজুর আলম চেয়েছেন ‘কমলা লেবু’ প্রতীক। অপরদিকে আ জ ম নাছির চেয়েছেন ‘হাতি’। এদিকে, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন রবিবার উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও আচরণ বিধির কারণে সোমবার ছিল অনেকটাই নীরবতা। কারণ, প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রচারে নামতে পারছেন না প্রার্থীরা। কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী মনোনয়নে হিমশিম অবস্থা ॥ ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে একক প্রার্থিতা নিশ্চিত হলেও কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছেন দুই বড় দলের নেতারা। গত রবিবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিনে সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের জন্য ৭১ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদের জন্য ২৮৮ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের সংখ্যা ১৪টি আর সাধারণ কাউন্সিলর পদের সংখ্যা ৪১টি। এ চিত্রই বলে দিচ্ছে, মেয়র পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও কাউন্সিলর পদে তা সম্ভব হয়নি। এর নেপথ্যে রয়েছে দু’দলেই নেতৃত্ব পর্যায়ে বিভেদ। মেয়র প্রার্থী হাইকমান্ড থেকে ঠিক করে দেয়ায় এক্ষেত্রে বিভক্তি দৃশ্যমান নয়। তবে নেতারা চাইছেন কাউন্সিলর পদে নিজের অনুসারীদের জিতিয়ে আনতে। ফলে একক প্রার্থিতা কঠিন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নগর ও জেলা পর্যায়ের নেতারা এখন কাউন্সিলর পদেও প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে প্রার্থী দেয়ার চেষ্টায় তৎপর রয়েছেন। উল্লেখ্য, আগামী ৯ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ। ফলে যা করার তা করতে হবে এর মধ্যেই। ৮ কাউন্সিলর প্রার্থী মামলার আসামি ॥ চসিকের আসন্ন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের মধ্যে ৮ জন বিভিন্ন মামলার আসামি। এদের মধ্যে কেউ আছেন কারাগারে, কেউ আছেন আত্মগোপনে। এরা হলেন চান্দগাঁও ওয়ার্ডের মাহবুবুল আলম, উত্তর পাহাড়তলীর আবদুস সাত্তার সেলিম, আলকরণের দিদারুর রহমান লাভু, পাথরঘাটার ইসমাইল বালি, উত্তর মধ্যম হালিশহরের হাসান মুরাদ, দক্ষিণ হালিশহরের শরফরাজ কাদের রাসেল, শুলকবহর ওয়ার্ডের শামসুজ্জামান হেলালী ও পাহাড়তলীর মাহফুজ আলম। এদের মধ্যে যারা কারাগারে আছেন তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন প্রাপ্তির চেষ্টায় রয়েছেন। তবে কারাগারে থেকে নির্বাচন করতে কোন আপত্তি নেই। বর্তমান একজন বাদে ৫৪ কাউন্সিলরই পুনঃপ্রার্থী ॥ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিতসহ ৫৫ জন বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে ৫৪ জন আবারও প্রার্থী হয়েছেন। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে এ কর্পোরেশনের নির্বাচনে ৪১ ওয়ার্ডে ১৯টিতে বিএনপি এবং ২টিতে জামায়াত সমর্থক কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এছাড়া সংরক্ষিত ১৪ কাউন্সিলর পদে ১১ আওয়ামী লীগ সমর্থিত, ২ জন বিএনপি সমর্থিত ও ১ জন বাসদ সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হন। ঘরোয়া প্রচার ॥ নির্বাচনের ২১ দিন আগে প্রকাশ্য কোন প্রচারণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রধান দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে এখন চলছে ঘরোয়া প্রচারণা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন ও বিএনপির সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলমের পক্ষে দলের স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে ঘরোয়া আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছেন। প্রচারের কাজটিও চলছে আড়ালে আবড়ালে। প্রার্থী হওয়ার আগে যে সব বিল বোর্ড ও পোস্টার ছাপানো হয়েছে তার মধ্যে বিল বোর্ডগুলো অপসারিত হলেও পোস্টার ছেয়ে আছে নগরীর বিভিন্ন স্পটে। তবে মনোনয়নপত্র দাখিলের পর কেউ এখনও পোস্টার লিফলেট প্রকাশ করেনি। এটি একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়মনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে। আগামী ১ ও ২ এপ্রিল বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে ৩ এপ্রিল। এরপর আগামী ৯ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন। পরদিন ১০ এপ্রিল প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ প্রদান করা হবে। একই প্রতীক একাধিক প্রার্থী পেতে আগ্রহী হলে এ নিয়ে লটারির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। আচরণবিধি লঙ্ঘন ৩ মেয়র ও ২৫ কাউন্সিলর প্রার্থীকে শোকজ ॥ চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ৩ মেয়র প্রার্থীসহ ২৮ জনকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়। সোমবার রিটার্নিং অফিসার মোঃ আবদুল বাতেন এ নোটিস প্রদান করেন। আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যাদের নোটিস দেয়া হয়েছে তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্র্থী সোলায়মান আলম শেঠ। বাকি যে ২৫ জনকে শোকজ করা হয় তারা সকলেই কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের কারণ পাওয়া যায়। ফলে রিটার্নিং অফিসার কার্যালয় থেকে সোমবার সন্ধ্যায় তাদের শোকজ করা হয়। সাতদিনের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে।
×