ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম শিরোপা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩০ মার্চ ২০১৫

অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম শিরোপা

মিথুন আশরাফ ॥ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ যে কী, তা বোধ হয় বুঝেই না অস্ট্রেলিয়ানরা। নাকি এতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে যে শিরোপা জয় ‘ডাল-ভাত’ হয়ে গেছে। তাই যদি না হবে তাহলে ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে ৭ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতা নিশ্চিত হতেই সাদামাঠা উদ্যাপন কেন করবেন মাইকেল ক্লার্করা! জিততে তখন ২ রান দরকার। এমন মুহূর্তে স্টিভেন স্মিথ বাউন্ডারি হাঁকালেন। পঞ্চমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। আনন্দে ক্রিকেটারদের ফেটে পড়ার কথা। আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ হলো কি। চিরাচরিত নিয়ম মতোই সব হলো। ক্রিজে থাকা স্মিথ ও ওয়াটসন গলায় জড়িয়ে ধরলেন। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা দৌড়ে এসে এ দুইজনকে ঘিরে ধরলেন। আনন্দ বলতে এই যা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া যে কোন দল চ্যাম্পিয়ন হলে, কী যে আনন্দ হতো; তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উপমহাদেশের কোন দল হলে তো কথাই ছিল না। আনন্দ আর আনন্দই হতো। উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে যেতেন ক্রিকেটাররা। সেই সঙ্গে পুরো জাতি! উৎসব যে করবেন ক্লার্করা, আসলে সেই রকম ম্যাচও তো হলো না। একদম একপেশে ম্যাচ হলো। যেখানে মনে করা হচ্ছিল দুই স্বাগতিক দেশ ফাইনালে খেলছে। চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে ম্যাচটি। উত্তেজনায় ঠাসা থাকবে। গ্রুপ পর্বে দুই দলের ম্যাচ যেমন উত্তাপ ছড়িয়েছে, তেমন কিছু একটারই দেখা মিলবে। নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ‘জান-প্রাণ’ বাজি লাগিয়ে দেবে। সঙ্গে ক্যান্সার আক্রান্ত সাবেক ক্রিকেটার মার্টিন ক্রো’র দেখা শেষ ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখবে। তার জন্য হলেও শিরোপা জিততে চাইবে। কিন্তু ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। উল্টো মাইকেল ক্লার্কের বিদায়ী ম্যাচটি হয়ে রইল স্মরণীয়। বিদায়ী ম্যাচে নিজেই বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে তুলে ধরলেন। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে টস জিতে যখন নিউজিল্যান্ড ব্যাট করতে নামল, দুই ওপেনার গাপটিল ও অধিনায়ক ম্যাককুলাম মাঠে নামতেই উত্তেজনা কাজ করল। কিন্তু মুহূর্তেই সেই উত্তেজনার ইতি ঘটল। শেষপর্যন্ত নিউজিল্যান্ড যে ১৮৩ রান করে ৪৫ ওভারেই অলআউট হয়ে গেল, সেখানেই তো ম্যাচ শেষ হয়ে গেল। তিন পেসার ৩ উইকেট করে নেয়া জনসন, ফকনার ও ২ উইকেট নেয়া স্টার্কই নিউজিল্যান্ডের শিরোপা জেতার স্বপ্ন শেষ করে দিলেন। ইলিয়ট (৮৩) ও টেইলর (৪০) মিলে যে চতুর্থ উইকেটে ১১১ রানের জুটি গড়লেন, ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের এই যা প্রাপ্তি হয়ে থাকল। এই রান তো খুব সহজেই অস্ট্রেলিয়া অতিক্রম করে ফেলবে, তা সবারই তখন ধারণা হয়ে যায়। শুধু অপেক্ষা থাকে ম্যাচ শেষ হওয়ার। কত দ্রুত তা শেষ হবে। ৩৩.১ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ক্লার্কের ৭৪, স্মিথের ৫৬ ও ওয়ার্নারের ৪৫ রানে ১৮৬ রান করে ম্যাচ জিতে গেল অস্ট্রেলিয়া। সেই সঙ্গে মাঝে একবার ছাড়া আবারও শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলল। আসলে ঘরের ছেলেরাই বিশ্বকাপ জিতল। বিশ্বকাপ যে এবার অস্ট্রেলিয়াতেই হয়েছে। আরেকটি দেশে হয়েছে, সেটি নিউজিল্যান্ড। সহআয়োজক ছিল। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষও। কিন্তু ম্যাচ নিউজিল্যান্ড খেলেছে, তা বোঝাই যায়নি। মনে হয়েছে শুধু অস্ট্রেলিয়াই খেলছে ফাইনাল। প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছে নিউজিল্যান্ড। মনে করা হচ্ছিল, এবার বোধ হয় নতুন কোন চ্যাম্পিয়ন দল পাওয়া যাবে। তবে এও ধারণা করা হচ্ছিল, মেলবোর্ন বড় মাঠ বলে ভুগতে হবে নিউজিল্যান্ডকে। এ মাঠই বাধা তৈরি হয়ে যেতে পারে। শেষপর্যন্ত তারই দেখা মিলল। বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার যে একটা চাপ নিতে হয়, সেটিও যেন নিতে পারল না নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়াতো সেই চাপ সবচেয়ে বেশি বার নিয়েছে। তাই ফাইনালে খেলার চাপ বলে অসিদের কাছে কিছুই ছিল না। এ নিয়ে যে সাতবার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলল অস্ট্রেলিয়া। সাতবারের মধ্যে পাঁচবারই শিরোপাও জিতে নিল। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপে ফাইনালে খেলেও রানার্সআপ হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯৬ সালেও তাই হয়েছে। ১৯৮৭ সালে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। এরপর ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ সালে টানা তিনবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। এ বার পঞ্চমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা মানেই হয় জিত নয়ত এমনভাবে হারতে হবে, যেখানে শুধু অস্ট্রেলিয়াকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৮৭ সালে শুধু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কষ্ট করে জিতে চ্যাম্পিয়ন হতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। ৭ রানে জয় মিলে ছিল। এছাড়া পরের তিনবার যে শিরোপা জিতে, খুব সহজে তিন উপমহাদেশের দলকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয় অসিরা। ’৯৯ সালে পাকিস্তানকে অনায়াসেই ৮ উইকেটে, ’০৩ সালে ভারতকে ১২৫ রানে, ’০৭ সালে শ্রীলঙ্কাকে বৃষ্টি আইনে ৫৩ রানে ও এবার স্বাগতিক ও প্রতিবেশী দেশ নিউজিল্যান্ডকেও পাত্তাই দিল না অস্ট্রেলিয়া। বড় ভাইরা যেন ছোট ভাইদের হারিয়ে দিল। এমন জয় পাওয়ার পর কী আর আনন্দ না হয়। কিন্তু কোথায় মিলল সেই আনন্দ, উৎসব। শেষে শিরোপা হাতে ক্রিকেটাররা আনন্দ করলেন, মাঠও প্রদক্ষিণ করলেন; আনন্দ তখনই মিলল। তবে ক্রিকেটারদের চেয়েও যেন আনন্দ পেলেন দর্শকরা বেশি। নিজ দেশে বিশ্বকাপ হয়েছে। সেই বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দই আলাদা। তবে টুর্নামেন্টে মোট ২২ উইকেট নিয়ে মিচেল স্টার্ক যে টুর্নামেন্ট সেরা হলেন এবং তাকে মঞ্চে পুরস্কার নিতে ডাকা হলো, তখনও দর্শকদের উচ্চৈঃস্বর মিলল না। এমনকি মাইকেল ক্লার্ককে যখন বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে তুলে দিতে ডাকা হলো তখনও দর্শকরা খুব বেশি সাড়া দিলেন না। যতটানা পুরস্কার মঞ্চে উপস্থিত বিশ্বকাপের এ্যাম্বাসেডর শচীন টেন্ডুলকরের নামটি বলতেই সাড়া পড়ে গেল। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়া জিতলেও খুব আহামরি কোন আনন্দ উদযাপন তাদের দিয়ে হচ্ছে না। এমনটি হতে পারে দুটি কারণে। একটি, বিশ্বকাপ এতবার জিতেছে অস্ট্রেলিয়া যে এ আর নতুন কী যে বিশেষ আনন্দ করতে হবে। আরেকটি, উপমহাদেশের কোন দল চ্যাম্পিয়ন হলে যে আনন্দ হয়, তেমনটি সেখানে হয়ই না। দ্বিতীয় কারণটিই সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে নিশ্চয়ই। তাতে কী আর অস্ট্রেলিয়ার কিছু যায় আসে। তারা তো আবারও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ১৯৯২ সালে নিজ দেশে হওয়া বিশ্বকাপে ফাইনালেই খেলতে না পারার দুঃখ এবার ভালভাবেই গুছিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। দিন শেষে জয়টিই মুখ্য। সেই জয়টি মিলেও গেছে এবং পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপও জিতে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
×