ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন ॥ সিভিল সার্জনদের প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী

মাঠ পর্যায়ে ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ফের নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩০ মার্চ ২০১৫

মাঠ পর্যায়ে ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ফের নির্দেশ

নিখিল মানখিন ॥ মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সিভিল সার্জনদের আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক মনিটরিং সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ নির্দেশ প্রদান করেন। কর্মস্থলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ইতোমধ্যে বৈদ্যুতিক হাজিরা মনিটরিং ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অনুপস্থিতির অভিযোগ উঠার প্রেক্ষিতে এ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ নির্দেশ পালনে অবহেলা করা হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও সভায় জানানো হয়। মনিটরিং সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কোন অভিযোগ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে এমন কোন পরিস্থিতি বরদাশ্ত করা হবে না। যে সিভিল সার্জন তাঁর অধীনস্থ চিকিৎসকদের গাফিলতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন না তাঁকেও জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, গ্রামের দরিদ্র মানুষ আজ যে কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কার্যক্রম। তিনি বলেন, এ ব্যবস্থা আরও গতিশীল ও দক্ষ করে তুলতে মাঠপর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ প্রোভাইডরদের আরও মনোযোগী ও সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত ক্লিনিকে থেকে সেবা না দেয়ার কোন অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের স্বাস্থ্যসেবা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশংসা কুড়াচ্ছে তাকে আরও উর্ধে তুলে ধরতে সকলকে কাজ করতে হবে বলে জানিয়ে দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের গত আমলেই স্বাস্থ্য সেক্টরের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিতকল্পে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৩ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক স্বয়ং দেশের প্রায় ৬ হাজার চিকিৎসককে কর্মস্থলে না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসকদের উপস্থিতি সরেজমিন দেখতে ১০ সদস্যের আকস্মিক পরিদর্শন টিম গঠন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সদস্য করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর কয়েকটি অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে কমিটির অভিযানে নেমে আসে স্থবিরতা। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও এ বিষয়ে বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এমনকি চাকরিচ্যুত করার মতো কঠিন শাস্তি দেয়ার হুমকিও দিয়ে আসছেন। কিন্তু কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত পরিদর্শন টিমের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। থানাপর্যায়ে টিমের সদস্যরা যান না। সরকারী চিকিৎসাসেবা এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক সরকারী চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও কর্মস্থলে সঠিক সময়ে উপস্থিত না হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, কার্যদিবসে অনেক সরকারী মেডিক্যাল শিক্ষক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কাজ করে থাকেন। তাঁরা দিনে নামমাত্র সময় দেন। দেশে বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর সাইনবোর্ডে ছেঁয়ে গেছে সরকারী চিকিৎসকদের নাম। নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পাশাপাশি সরকারী হাসপাতালের রোগী নিজেদের চুক্তিবদ্ধ চিকিৎসালয়ে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক সরকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। অনেক চিকিৎসক তদ্বির চালিয়ে অবস্থান করছেন নিজেদের সুবিধাজনক এলাকায়। জেলা এমনকি বিভাগীয় কার্যালয়ে তাঁদের অনেকে দায়িত্ব পালন করছেন। যোগদান করার পরই কর্মস্থলে অনেকের দেখা মেলে না। তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ। অথচ প্রত্যেক চিকিৎসককে প্রাথমিকভাবে গ্রামপর্যায়ে চিকিৎসাসেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিকিৎসকদের উপস্থিতি সরেজমিন দেখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দশ সদস্যের আকস্মিক পরিদর্শন টিম নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে আসছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তাঁর নির্দেশে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ‘বৈদ্যুতিক হাজিরা মনিটরিং ব্যবস্থা’ চালু করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরাধীন অনেক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহে ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে বায়োমেট্রিক যন্ত্র। এর আগে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি। অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে উপস্থিত না হয়েও নানা কৌশলে উর্ধতন কর্মকর্তাদের খুশি করিয়ে হাজিরা খাতায় ‘উপস্থিতি’ দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়েছে, কর্মস্থলে চিকিৎসকদের ইলেক্ট্রনিক হাজিরা মনিটরিং করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বায়োমেট্রিক মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত মেশিনে চিকিৎসকদের ইলেক্ট্রনিক হাজিরা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘বায়োমেট্রিক মেশিন কোন সময় অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে বলে জানানো হয় পরিপত্রে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথমে দেশের কিছুসংখ্যক সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বায়োমেট্রিক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। তখন চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিতে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্থাপিত বায়োমেট্রিক মেশিন নষ্ট করার অভিযোগ তুলেছিল খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরেকটি আদেশ পাঠানো হয় সিভিল সার্জন এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের কাছে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি দেশের সব সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো এক আদেশে নিজ নিজ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে হাজিরা মনিটরিংয়ের জন্য স্থাপিত বায়োমেট্রিক মেশিন নষ্ট করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে তিন কর্মদিবসের মধ্যে অধিদফতরকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশ অনুযায়ী সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কোন তথ্যই পাঠাননি। এ অবস্থায় আরও দুই কর্মদিবস সময় বেঁধে দিয়ে ওই সব যন্ত্র নষ্টের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া এবং আগের নির্দেশ কেন কার্যকর হয়নি সে ব্যাখ্যাও জানাতে বলা হয়। তা না হলে যে কর্মকর্তারা তথ্য পাঠাননি, তাঁদের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছিল ওই চিঠিতে। কিন্তু তাতেও সাড়া না পেয়ে দেশের সব সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বায়োমেট্রিক স্থাপন এবং তা সংরক্ষণে পরিপত্র জারি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এদিকে স্বাস্থ্য সেক্টরের সরকারী চিকিৎসক ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হয়ে আসছে। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকদের কেউ কেউ কর্মস্থলে গিয়ে উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর দিয়েই চলে যান। অনেকে আসেন দিনের শেষ বেলায়। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসকদের দেখা পায় না রোগীরা। তবে নিজেদের আবাসিক কক্ষে গড়ে তোলা অবৈধ চেম্বারে অফিস সময়ে চড়া ফি নিয়ে রোগী দেখতে ভোলেন না চিকিৎসকরা। মাঠ পর্যায়ে ডাক্তারদের গরিব রোগীরা বিনামূল্য চিকিৎসায় স্বাস্থ্য কার্ড পাবেন ॥ গরিব ও দুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানে সরকার থেকে স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করা হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। রবিবার জাতীয় সংসদে সরকারী দলের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নূরজাহান বেগমের ৭১ বিধিতে আনীত নোটিসের জবাব দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে সব পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল মেয়াদী একটি কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। পাইলট স্কিম হিসেবে এটা অচিরেই চালু করে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে তা চালু করা হবে।
×