ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সীমান্ত বরাবর মাদ্রাসা থাকায় জেএমবি সুবিধা পাচ্ছে বরেন্দ্রে

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৩০ মার্চ ২০১৫

সীমান্ত বরাবর মাদ্রাসা থাকায় জেএমবি সুবিধা পাচ্ছে বরেন্দ্রে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জেএমবির দুই শীর্ষ জঙ্গী ধরা পড়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবি আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। শতাব্দী শুরুর প্রথমদিকে অর্থাৎ ২০০০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত জেএমবির তৎপরতা খুবই বেড়ে যাওয়ার কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পাঁচ উপজেলায় পুলিশ তৎপর হয়ে উঠে। শহরের পাঠানপাড়া এলাকার একটি মেসবাড়িকে প্রধান কার্যালয় করে সাংগঠনিক ও জঙ্গী তৎপরতা চালাতে বিভিন্ন ধরনের মরণাস্ত্র তথা বোমা, টাইমবোমা ও রিমোট কন্ট্রোল সরঞ্জামাদি তৈরি করাসহ প্রত্যক্ষ ট্রেনিং পরিচালনা করতে গিয়ে বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ অভিযানে নামে। একাধিক জঙ্গীনেতাসহ বোমা, টাইমবোমা তৈরির নির্দেশনা বই, নানান ধরনের নিষিদ্ধ লিফলেট, বই, চাঁদা উঠানোর বহি, সংগঠনের প্রতি আনুগত্যের হলফনামা ইত্যাদি উদ্ধার হলে কিছু সময়ের জন্য দৃশ্যমান তৎপরতা থেমে যায়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এ অভিযান থেকে যে সব তথ্য বেরিয়ে আসে পুলিশ তার সূত্র ধরে এগোবার চেষ্টা করেনি। পরবর্তীতে শহরের বিভিন্ন মহল্লায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে জঙ্গী তৎপরতা ও সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে গেলেও মাঝে মধ্যে পুলিশ তৎপরতা ছাড়া কোন দৃশ্যমান জঙ্গীদের বিরুদ্ধে মারমুখী নিশ্চিহ্ন করার মতো কিছু হয়নি। এ সময়ে গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের কাছে বেশকিছু মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার নাম উঠে এলেও ওই সব কওমি মাদ্রাসার কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের মতো তৎপরতাও নজরে আসেনি। এমনকি খুবই প্রশ্নবিদ্ধ শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে হাজারবিঘী চাঁদপুর ইসলামিয়া কওমি মাদ্রাসার কোন শিক্ষক বা ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রথম জঙ্গী অভিযানে যে কজন জঙ্গী ধরা পড়ে তার মধ্যে এই কওমি মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই ছাত্র জঙ্গী ধরা পড়ার পর পুরো মাদ্রাসাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক শিক্ষক অসতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়াসহ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছিল। এই কওমি মাদ্রাসাটির অবস্থান একটি নির্জন স্থানে, বিশাল আমবাগানের মধ্যে। মাদ্রাসার একটি মার্কেট, শত বিঘা জমি, আমবাগানসহ ২০ কোটি টাকার অধিক মূল্যের সম্পদ রয়েছে। অথচও স্থানীয় লোকজন এ মাদ্রাসার কার্যকলাপ সম্পর্কে তেমনভাবে কিছু জানে না। শিবগঞ্জ উপজেলায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ১০টি অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার অবস্থান সীমান্ত বরাবর। তাই ছাত্র-শিক্ষকরা অবাধে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাতায়াত করে। ২০০৭ সালের পর ইয়াজ উদ্দীনের তথাকথিত মইনুদ্দিন ফখরুদ্দিন সরকার এলে জেএমবি তৎপরতা অর্থাৎ জঙ্গী হামলা কিছুটা কম হলেও বেড়ে যায় সাংগঠনিক তৎপরতা। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে জঙ্গীরা জেলার নির্জন বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে ও বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থান নিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গী তৎপরতা শুরু হলে হরতাল-অবরোধের মধ্যেই জেএমবির জঙ্গীরা খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে। বিভিন্ন এলাকায় শুরু করে সাংগঠনিক তৎপরতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবরোধ-হরতালে দায়িত্ব পালনে সর্বক্ষণিক রাস্তা ও মাঠে থাকায় জেএমবি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট, নিয়ামতপুর, গোদাগাড়ীসহ রাজশাহী নওগাঁর বিভিন্ন থানায় শুরু করে সাংগঠনিক তৎপরতা। তিনি জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মসজিদকে ব্যবহার করে জঙ্গীরা মাঠে নেমে পড়ে। এমনকি তবলিগ জামাতে ঢুকে পড়ে এলাকাভিত্তিক তৎপরতা চালাতে থাকে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, তারা গত তিন মাসে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় পাঁচ হাজারের অধিক কর্মী তৈরি করেছে। সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ জাতীয় স্বাধীনতা দিবসের পূর্বেমূহূর্তে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি মুহূর্তে ২৫ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেএমবির দুই শীর্ষনেতা গ্রেফতার হলে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বেরিয়ে আসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে। তারা এখন প্রায় তিন শ’ জেএমবির তালিকা নিয়ে মাঠে রয়েছে গ্রেফতারের জন্য। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবির চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমির ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান আশরাফুল ইসলাম ওরফে রনি ও আব্দুল মোতাকাব্বির। পুলিশ এদের নাচোল এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত জেএমবি নেতা আব্দুল মোতাকাব্বির ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জেএমবির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি আটক আশরাফুল এখন জেলার সাংগঠনিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে এ আশরাফুল জেলার দায়িত্বে রয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন। আশরাফুলের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার দেবীনগরের চরাচাকলা গ্রামে। পিতা আব্দুল হক একজন কট্টর জামায়াতপন্থী বলে জানা গেছে। দুর্ধর্ষ এই দুই জেএমবি নেতা ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল দলীয় কোন্দলে দ্বিমত প্রকাশ করায় নাচোলে সলেমান নামের এক যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করে। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে তারা বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে আসছিল বলে জানান। এছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও আশপাশ এলাকার জেএমবি সদস্যদের নাম ঠিকানাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। পুলিশ তদন্ত ও নিরাপত্তার কারণে জঙ্গীদের দেয়া তথ্যাদি ফাঁস করতে চাচ্ছে না।
×