ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাগরিক সমাজের জাতীয় কনভেনশন

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় সংহতি দৃঢ়করণই সঙ্কট উত্তরণের উপায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৯ মার্চ ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় সংহতি দৃঢ়করণই সঙ্কট উত্তরণের উপায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী কর্মকা- সময়ে সময়ে বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাজনীতির নামে বর্তমানে যা ঘটছে সেটি তারই ধারাবাহিকতা। এর মূলে রয়েছে ’৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের পুনর্বাসন, অর্থনৈতিক উত্থান, এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতারও নিয়ন্ত্রণ। সেই ক্ষমতা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে তারা দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের এই আদর্শিক বিভ্রান্তি এবং সামাজিক বিভাজন দূর করতে সচেতন নাগরিকদেরই উদ্যোগী হতে হবে। নাগরিক ঐক্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং সংবিধানের চার মূল স্তম্ভের আলোকে জাতীয় সংহতি দৃঢ়করণই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায়। শনিবার রাজধানীতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সম্মিলিত নাগরিক সমাজ আয়োজিত ‘সহিংসতা-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ও অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে এক হও’ শীর্ষক জাতীয় কনভেনশনে বক্তারা এসব কথা বলেন। আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে এই কনভেনশনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা চলমান সঙ্কট নিরসনে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখার ঘোষণা দেন। প্রসঙ্গত, নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি, বিভিন্ন পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ ও উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, কৃষক ও কৃষি শ্রমিক, নারী, যুবক ও শিক্ষার্থী সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘সম্মিলিত নাগরিক সমাজ’ নামে এই প্লাটফর্ম গঠন করা হয়েছে। দেশব্যাপী সহিংসতা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নাগরিক ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে আহ্বায়ক করে কনভেনশনে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার ৪২ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। নাট্য ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ এ কমিটির সদস্য সচিব। কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন আরেক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। সম্মিলিত নাগরিক সমাজের বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে জেলা পর্যায়ে ন্যূনতম ৩১ ও উপজেলা পর্যায়ে ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি তৈরির ঘোষণা দেয়া হয়। তবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কাউকে এসব কমিটিতে রাখা হবে না বলেও কনভেনশনে জানানো হয়। কনভেনশন পরিচালনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের (বিইউপি) নির্বাহী পরিচালক ড. নিলুফার বানু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের সভাপতি একেএম হামিদ। কনভেনশনের শুরুতে গত দুই মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে দগ্ধ মানুষের আর্তনাদের একটি মর্মস্পর্শী ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। টানা হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শ্রমিকদের প্রতিনিধিরাও এ সময় মিলনায়তনে উপস্থিত ছিলেন। জানুয়ারি মাসে গাবতলীতে পেট্রোল বোমা হামলার শিকার ট্রাকচালক আমির হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি গরিব মানুষ। রাজনীতির কিছুই বুঝি না। তাও আমার ওপর ক্যান পেট্রোল বোমা মারল। আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা যে কত কষ্টের তা গত দুই মাসে আমি বুঝছি। যারা রাজনীতি করেন, দোহাই লাগে এমন মানুষ মারার রাজনীতি বন্ধ করেন। নরসিংদীর কৃষক মোশাররফ হোসেন বলেন, আগে নরসিংদী থেকে ঢাকায় ৩-৪ হাজার টাকা ভাড়ায় ট্রাক আসত। হরতাল-অবরোধের কারণে কৃষিপণ্যবাহী এসব ট্রাকের ভাড়া এখন ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। এভাবে চলতে থাকলে প্রান্তিক চাষীরা ধ্বংস হয়ে যাবে। সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ সম্মিলিত নাগরিক সমাজের পক্ষে লিখিত ‘প্রেক্ষিত ও প্রস্তাবনা’ তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, চলমান বিভিন্ন সঙ্কটের মূল কোথায়? অনেকের দাবি একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তিত হলেই এ সঙ্কট কেটে যাবে। কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অতীতে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও পরাজিত রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে সংসদে অংশ নেয়নি। উল্টো রাজপথে আন্দোলনের নামে হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছে। তাই কেবল নির্বাচন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সঙ্কটের সমাধান নেই। গত ২৫ বছরে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। রাজনীতির আবরণে জঙ্গী তৎপরতা চলছে। তাই মূল সমস্যা চিহ্নিত করে নাগরিকদের শুধু সচেতন নয়, সক্রিয়ও হতে হবে। ড. খলীকুজ্জমান বলেন, সঙ্কটের শেকড় সন্ধানে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। ঐক্যের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করা বাঙালীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র শুরু হয় একাত্তরেই। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমেই সেই ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তির পুনর্বাসন, অর্থনৈতিক উত্থান এবং ইতিহাস বিকৃতির শুরু। এ অপশক্তিকে দমন না করা পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র ও শান্তি আসবে না। খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, স্বাধীনতাকে সংহত করা মানে জনতার ঐক্যকে সংহত করা। চলমান সঙ্কটে সাধারণ নাগরিকরা আক্রান্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাই এর সমাধানে নাগরিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্যই পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা চালানো হচ্ছে। জনতা ঐক্যবদ্ধ হলে সব অপশক্তিকে একাত্তরের মতো পরাজিত করে নির্মূল করা সম্ভব হবে। এজন্য তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্মুক্ত ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের দাবি জানান। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী ইশতিহারে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, কেবল সেগুলোর বাস্তবায়নেই তাদের কঠোর কর্মসূচী দেয়া উচিত। আইএসএলডিএসের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ চৌধুরী বলেন, একাত্তরে সর্বস্তরের জনতা যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, চলমান পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস দমনে নাগরিকদের একইভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সন্তানদের পারিবারিকভাবে সচেতন করা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খাঁন বীরবিক্রম বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেয়া প্রজন্মটিকে তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে উদ্ধার করতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য সঠিক ইতিহাস পুনঃস্থাপন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে এই নতুন প্রজন্মকে।
×