ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

খুনীদের আদালতে স্বীকারোক্তি

নেপথ্য কাহিনী ॥ শিমুর লাশ দশ টুকরো-ঘটনা উন্মোচিত হলো যেভাবে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৯ মার্চ ২০১৫

নেপথ্য কাহিনী ॥ শিমুর লাশ দশ টুকরো-ঘটনা উন্মোচিত হলো যেভাবে

শংকর কুমার দে ॥ যেভাবে রহস্য উন্মোচিত হলো সেই হতভাগ্য তরুণীর, যাকে খুনের পর লাশ দশ টুকরো করে ফেলে দেয়া হয়েছিল, জানা গেল তার নেপথ্য কাহিনী। শুধু তাই নয়, পৈশাচিকভাবে খুন করার পর পুলিশ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য দেহের বিচ্ছিন্ন অংশে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বিকৃত করে একেক জায়গায় ফেলে দেয়া হয়। ক্লুবিহীন এই খুনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া গেছে আদালতে দেয়া খুনীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে। খোদ রাজধানীতে এই ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। সোর্স নিয়োগ করে পুলিশ। সোর্স মারফাত খবর পাওয়া যায় হত্যাকা-টি ঘটেছে ফকিরাপুল এলাকায়। নিহত তরুণীও পুলিশের সোর্স। কারাগারে বন্দী পুলিশের অপর সোর্স তার স্বামী নাসিরউদ্দিন। পুলিশী অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ পাওয়া যায় ফকিরাপুলের ১৯৩/২ নম্বর বাড়ির দেয়ালে। যে দেয়ালে রক্তের দাগ পাওয়া যায় সেই সাততলা বাড়ির সিড়ির শেষ প্রান্ত থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিল মাথার অংশবিশেষ। সেই রক্তের দাগ ধরে যেতে যেতে পুলিশ সিঁড়ি বেয়ে ওঠে যায় বাসার ছাদে। পুলিশকে ছাদে উঠতে হয়েছে দরজার তালা ভেঙ্গে। পুলিশের তল্লাশির খবর পেয়েই পালিয়ে যায় বাড়ির মালিক মোবারক হোসেন মন্টি। ছাদের দরজার তালার চাবি নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় বাড়ির মালিক। পলাতক মোবারক হোসেন মন্টি একজন মাদক ব্যবসায়ী। বাড়ির চারতলায় তারা বসবাস করে। চারতলা থেকে আটক করা হয় তার স্ত্রীকে। মন্টির স্ত্রীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই নৃশংস হত্যাকা-ের কথা। এভাবেই জানা যায় হতভাগ্য নারীর নাম, পরিচয় ও ঠিকানা। পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে বাড়ির মালিক মাদক ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন মন্টিসহ ছয়জনকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। খুনীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানা যায় খুনের নৃশংসতার বিবরণ। খুন হওয়া তরুণীর নাম শিমু ওরফে সুমি (২০)। স্বামীর নাম নাসিরউদ্দিন। গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুর। শিমু স্বামীর সঙ্গে থাকত ঢাকার ফকিরাপুলে। তার খুন হওয়ার আগে স্বামী কারাগারে। জানা যায় হত্যার আগে শিমুকে সেবন করানো হয় ইয়াবা। ইয়াবার নেশায় যখন টালমাটাল তখনই ঘটানো হয় হত্যাকা-। খুন হওয়া শিমুর স্বামী নাসিরও মাদক ব্যবসায়ী। যারা খুন করেছে তাদের সঙ্গেই মাদক ব্যবসা করত সে। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরোধ হলে স্ত্রীকে খুন করার ৪/৫ দিন আগে তারা ইয়াবাসহ ধরিয়ে দেয় নাসিরকে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদ- দেয়। স্বামীকে ধরিয়ে দেয়ায় ক্ষুব্ধ শিমু মাদক ব্যবসায়ী মন্টিসহ অন্যদের মাদক ব্যবসার কথা পুলিশকে জানিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। শিমুর মুখ বন্ধ করতেই তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর চেষ্টা করা হয় হত্যাকা-ের নিশানা মুছে ফেলতে। শিমু তাদের পরিচিত এবং তারা শিমুকে ঘটনার রাতে ধরে নিয়ে বাসার ছাদে হত্যা করে। গত ৯ মার্চ। ফকিরাপুল পানির ট্যাংক এলাকায় সাততলা একটি বাড়ি। বাড়ির ছাদেই খুন করা হয় শিমুকে। খুনের পর তার লাশ করা হয় দশ টুকরো। শরীরের বিভিন্ন অংশ কেরোসিনের আগুনে পুড়িয়ে বিকৃত করা হয়। আর সেই বিকৃত অংশগুলো ফেলে দেয়া হয় নানা জায়গায়, যাতে শনাক্ত করা না যায়। হত্যাকা-ের আগে শিমুকে ইয়াবা সেবন করিয়ে মাতাল করা হয়। তারপর তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখে কাগজ ঢুকিয়ে টেপ দিয়ে মুখ আটকে দেয়া হয় যাতে সে চিৎকার করতে না পারে। লাশ টুকরো টুকরো করা হয় খাটের ওপর রেখে কুপিয়ে। বাড়ির মালিক মোবারক হোসেন মন্টির বাসার ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি এবং লাশ টুকরো করায় ব্যবহৃত দাসহ আরও অনেক আলামত। পরের দিন গত ১০ মার্চ। দুপুর প্রায় সোয়া একটা। পুলিশ মতিঝিল থানার কালভার্ট রোড এলাকায় হোটেল উপবনের পাশে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি হাত ও একটি পায়ের কাটা অংশ উদ্ধার করে। এরপর পুলিশ অনুসন্ধানে নেমে একই দিন ফকিরাপুল ওয়াসা ভবনের দেয়ালের পাশ থেকে উদ্ধার করে একটি বিচ্ছিন্ন পা। আর সেখান থেকে একটু দূরে ময়লা-আবর্জনার ভেতর থেকে উদ্ধার হয় একটি হাত ও একটি বাহু। শরীরের এইসব বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল বিকৃত-পোড়া। আরও খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের পূর্ব পাশে ওয়াসার স্টোর রুমের টিনের চালায় বিছানার চাদর দিয়ে বাঁধা কিছু ঝুলতে দেখা যায়। টিনের চালায় উঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা বিছানার চাদর খুলে পাওয়া যায় আংশিক মাথা। মাথা উদ্ধার করা হয় হাত-পাবিহীন। তারপর ১৯৩/২ ফকিরাপুলের সাত তলা আহসান মঞ্জিলের সাত তলার সিঁড়ির শেষ প্রান্তে আগুনে দগ্ধ মাথার আংশিক খুলি উদ্ধার করা হয়। আর তা ছিল ছাই-কালি মাখানো। পুড়িয়ে বিকৃত করার কারণে মাথার চুল ছিল না। পুলিশ বুঝতেই পারছিল না যে, টুকরো টুকরো লাশের অংশগুলো নারী নাকি পুরুষের? লাশের টুকরো অংশগুলো একজনেরই কিনা ? শরীরের বিছিন্ন বিকৃত অংশগুলো জোড়া লাগানো হয়। তারপর একজন মানুষের অবয়ব পায়। মানুষের অবয়ব পাওয়ার পর সেটা পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবে। ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। তারপর প্রমাণ হয় বিচ্ছিন্ন অংশগুলো একজনেরই এবং তিনি একজন তরুণী। তার বয়সও জানা যায় পরীক্ষায়। তখনও পরিচয় বা নাম জানা যায়নি সেই হতভাগ্য তরুণীর। দশ টুকরো লাশের সেই তরুনণীর লাশ শনাক্ত করে ক্লু¬বিহীন হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনের তদন্তের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপ-পুলিশ কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর।
×