স্টাফ রিপোর্টার ॥ উপকূলীয় এলাকার বালু থেকে খনিজ আহরণে সরকারের অনুমতি চাইছে অস্ট্রেলীয় কোম্পানি প্রিমিয়ার মিনারেলস লিমিটেড। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খনিজ বালুর মজুদ বাংলাদেশে রয়েছে বলে সরকারকে এক চিঠিতে জানিয়েছে কোম্পানিটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন বালুর বিভিন্ন খনিজ আহরণ করা হলেও আমাদের এখানে তা হচ্ছে না। পরমাণু শক্তি কমিশন ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে গবেষণা করে গেলেও খনিজ আহরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। মূলত বিপুল বিনিয়োগ এবং খনিজের বাণিজ্যিক বিপণন ব্যবস্থা সম্প্রসারণে কমিশন কার্যকর কিছু করে উঠতে না পারায় মূল্যবান খনিজ আহরণ করা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সিরামিক এবং রঙশিল্প ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পে এসব খনিজের বিপুল চাহিদা রয়েছে, এখন যার পুরোটাই আমদানি করা হয়। ভবিষ্যতে এসব খনিজ থেকে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের জ্বালানিও পাওয়া যেতে পারে। তবে বিষয়টি সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে তা এখনই কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। বালু প্রক্রিয়াজাত করে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার খনিজ আহরণ সম্ভব বলে জানা গেছে। এই খনিজ বালুকে মহামূল্যবান কালো সোনা মনে করা হয়। জানতে চাইলে বালুতে খনিজ আবিষ্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূতাত্ত্বিক ড. ইউনুস আকন্দ জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতের তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা ও কেরালায় বালু থেকে খনিজ আহরণ করা হচ্ছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় একই ভাবে খনিজ আহরণ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক দিন ধরে চেষ্টা করেও আমরা কিছু করতে পারছি না, যা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, অস্ট্রেলীয় এই কোম্পানিটি অনেক দিন ধরে আমাদের এখানে খনিজ আহরণের চেষ্টা করছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলে আমাদের এখানে বালু থেকে খনিজ তুলতে দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা নীতিমালা হওয়া দরকার, যার মাধ্যমে বালু থেকে মূল্যবান খনিজ তোলা যাবে। তিনি বলেন, অন্য দেশে পরিবেশ বিপর্যয় না হলে আমাদের এখানে কেন পরিবেশ বিপর্যয় হবে? তিনি বলেন, পুরো বালু বিচ থেকে তুলে আনা হয় না। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ ভাগ বালু তোলা হয়। বাকিটা বিচে থাকে। এতে পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না।
সম্প্রতি প্রিমিয়ার মিনারেলস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্রান্ট ফিগত্রি বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে লেখা চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও দ্বীপের বালুতে মূল্যবান খনিজ রয়েছে। খনিজ আহরণের অনুমতি চেয়ে চিঠিতে বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে দেশের কক্সবাজার এলাকায় আমরা এ বিষয়ে গবেষণা করে আসছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম খনিজ বালু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে জেনেছি যে, এখানকার খনিজ বালুর মজুদ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। বালু থেকে এই খনিজ আহরণ করা সম্ভব। এই বালু থেকে আহরিত রুটাইল ও জিরকনের পৃথিবীব্যাপী চাহিদা রয়েছে। বছরের পর বছর এই বালু থেকে খনিজ আহরণ করা সম্ভব। এটা করতে গিয়ে পরিবেশেরও কোন ক্ষতি হবে না।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রিমিয়ার মিনারেলসের আগে ২০০৯ থেকে ২০১০ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও দ্বীপের বালু উত্তোলন করার জন্য অন্তত ১১টি খনিজ লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছিল। সরকার এর একটিতেও সাড়া দেয়নি। তবে প্রিমিয়ার মিনারেলসের দাবি, তাদের প্রতিষ্ঠানকে কক্সবাজারের টেকনাফের খনিজ বালু বাণিজ্যিকভাবে আহরণের নিশ্চয়তা দিয়েছিল সরকার।
চিঠিতে বলা হয়, যদি সরকার খনিজ বালু থেকে খনিজ আহরণের অনুমতি দেয় তাহলে এ থেকে প্রাপ্ত জিরকন, রুটাইল ও গারনেটের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ সেরা নেতৃত্ব দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের সমুদ্রের খনিজ বালু থেকে খনিজ আহরণ করে বিশ্ববাজারে ভারত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। অথচ ভারতের খনিজ বালু থেকে বাংলাদেশের বালু অনেক সমৃদ্ধ। কারণ বাংলাদেশের সাগর অঞ্চল দিয়েই হাজার বছর ধরে এই বালু ভারতের উড়িষ্যা সমুদ্র সৈকতে স্থান নিয়েছে।
জানতে চাইলে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম ফিরোজ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রিমিয়ার দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে। আমি চেয়ারম্যান থাকার সময় তাদের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছিল। এসব বিষয় দীর্ঘদিন অবেহলা করা হলেও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে এখন সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এককভাবে পরমাণু শক্তি কমিশনের পক্ষে বালু থেকে খনিজ আহরণ সম্ভব নয়। এজন্য অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করা যেতে পারে। ভারি খনিজ বালু থেকে খনিজ আহরণের অনুমতি দেয়া হলে এর বিনিময়ে প্রিমিয়ার বাংলাদেশকে কর্পোরেট ট্যাক্স হিসেবে ২০ বছরে দুই বিলিয়ন ডলার দেবে। বাংলাদেশের নদীর তলদেশ, সমুদ্র উপকূল ও দ্বীপে মহামূল্যবান ভারি খনিজ বালু রয়েছে। প্রিমিয়ার মিনারেলস শুধুমাত্র সমুদ্র উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের বালু থেকে খনিজ উত্তোলন করতে চায়।