ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

‘বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র’ একটি পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২৮ মার্চ ২০১৫

‘বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র’  একটি পর্যালোচনা

[ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ও নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল আরও আগে ১৯৬২ সালে। তার কথা কাজী আরেফ বলেছেন, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস’ পরিচ্ছেদে] এই পর্বে পড়ুন এরই ধারাবাহিকতা। নবেম্বর মাসে বাংলার স্বাধীনতা এবং বাঙালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি তথা বাঙালীর ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন, সংগ্রাম ও লড়াইয়ের জন্য সুশৃঙ্খল জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমরা (সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমি) ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করি। ’৬৪ সালের জুলাই মাসে এর সাংগঠনিক কাঠামো গঠন করা হয়। তিন সদস্যবিশিষ্ট নিউক্লিয়াস বা হাইকমান্ড গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনজন : সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমি। ’৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির পর তাঁর সঙ্গে ‘নিউক্লিয়াস’ ঘনিষ্ঠ হয়।” (পৃষ্ঠা, ৫৬) বঙ্গবন্ধু ছাড়াও যাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা বিপ্লবী পরিষদ পেয়েছিল তাঁদের কথা কাজী আরেফ লিখেছেন। তাঁরা হলেন : চট্টগ্রামের এমএ আজিজ ও এমএ হান্নান, যশোরের মোশাররফ হোসেন, দিনাজপুরের ইউসুফ আলি, মাগুরার সোহরাব হোসেন এবং ঢাকার তাজউদ্দীন আহমদ। সেসময় বাংলার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, এমন কয়েকজনের নামও পাওয়া যায়। এঁরা হলেন বিচারপতি মোঃ ইব্রাহিম, রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর ড. আহমদ শরীফ, ডাক্তার আবু হেনা প্রমুখ। কাজী আরেফ লিখেছেন, “ডা.আবু হেনা ‘নিউক্লিয়াসের’ বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কলকাতায়ও গিয়েছিলেন।” (পৃষ্ঠা, ৫৭) এই পরিচ্ছেদে গোটা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ‘নিউক্লিয়াসের’ আন্দোলন ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের চিত্রটি পাওয়া যায়। জিন্নাহ’র দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট ‘পাকিস্তান’ ও তথাকথিত ‘পাকিস্তান জাতি’ সৃষ্টির পদক্ষপের বিরুদ্ধে বাঙালীর জাতিসত্তার উন্মেষের লক্ষ্যে ছাত্রলীগের মধ্যে প্রচারধর্মী আন্দোলন গড়ে তোলে ‘নিউক্লিয়াস’। “’৬৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনশত (৩০০) ইউনিট/ফোরাম গঠন করতে সক্ষম হই। প্রতি ইউনিটে সাত/নয় (৭/৯) জন করে সদস্য ছিল। প্রতিটি মহকুমার অধীন বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫ সদস্য নিয়ে গোপন কমিটি ফোরাম গঠিত হতো। ’৬৮-’৭০-এ নিউক্লিয়াসের সদস্য বৃদ্ধি পেয়ে ৭ হাজারে দাঁড়ায়।” (পৃষ্ঠা, ৫৮) কয়েকটি ক্যান্টিন ও রেস্টুরেন্টের কথা আছে যেখানে নিউক্লিয়াস নেতৃবৃন্দের গোপন বৈঠক হতো, যেমন : মধুর ক্যান্টিন, নীলক্ষেতের আনোয়ারা রেস্টুরেন্ট, মেডিক্যাল হোস্টেলের পাশে পপুলার-হাসিনা-কাফে কাশ রেস্টুরেন্ট, তোপখানায় গুলনার, ও ইসমত রেস্টুরেন্ট, ইকবাল হলের ক্যান্টিন ও সদরঘাটের রুচিতা হোটেল। বেশ কয়টি হল, হোস্টেল ও মাঠের নামও পাই, যেমন : প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হল, ইকবাল হলের টেনিস কোর্ট ও মাঠ, এসএম হল, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ, রেসকোর্স, কালীবাড়ি মন্দির, আউটার স্টেডিয়াম, রমনা পার্ক, ধুপখোলা মাঠ, মিরপুরের বাগানবাড়ি। টিকাটুলিতে কাজী আরেফের পৈত্রিক বাড়িরও উল্লেখ আছে। (পৃষ্ঠা, ৫৮-৫৯) বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নাম আছে। বিপ্লবী পরিষদের সদস্য নির্বাচনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। “নিউক্লিয়াসের অনুমোদন সাপেক্ষে বিপ্লবী পরিষদের সদস্যপদ চূড়ান্ত হতো। যে কোন সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণের চূড়ান্ত অধিকারী ছিল ‘নিউক্লিয়াস’। এ ছাড়াও সিরাজুল আলম খানের তত্ত্বাবধানে মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), আসম আবদুর রব, সাজাহান সিরাজ, স্বপন কুমার চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), আমিনুল হক বাদশা, এ্যাডভোকেট চিত্তরঞ্জন গুহ ও নুরে আলম জিকুর মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করা হতো।” (পৃষ্ঠা, ৬৯) কাজী আরেফ উল্লেখ করছেন, ‘১৯৬৯ সালের পর স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য হিসেবে নারী সদস্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।’ বেশ কয়েকজনের নাম আছে। রাশেদা (পরে বাসস-এর সাংবাদিক), মমতাজ বেগম, শামসুন্নাহার ইকু, রাফিয়া আখতার ডলি, ফরিদা খানম সাকি, রাবেয়া হায়দার, ফরকান বেগম, আফরোজা হক রীনা, আমেনা সুলতানা বকুল, উম্মেল ওয়ারা বকুল, হোসনে আরা বকুল, নুর রোকসানা চৌধুরি, শাহিদা খাতুন, শিরিন আখতার, লুতফা হাসিন রোজী, নাজমা শাহীন বেবী, কাজী ফেরদৌসি হামিদ লীনু, রুবা ও নাসিরা। সাজেদা চৌধুরীর কথা উল্লেখ করেছেন (বর্তমানে ডাক্তার)। লিখেছেন, ‘সাজেদা স্কুলে থাকা কালে তার হাতের লেখায় ‘বিপ্লবী বাংলা’ পত্রিকা সাইক্লোস্টাইল করে বের করা হয়।” (পৃষ্ঠা, ৬০) ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হয়ে আসার পর বঙ্গবন্ধুকে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যুক্ত করার কথা আগে বলেছেন কাজী আরেফ। এরই ধারাবাহিকতায় কাজী আরেফ লেখেন, ‘’৭০ সালের নবেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিউক্লিয়াস ও বিএলএফের কর্মপদ্ধতি, সাংগঠনিক বিস্তৃতি, ও বিস্তারিত কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোসহীন হন।’ কী বই-পুস্তক তারা পড়তেন? “কামরুদ্দিন সাহেব তার লেখা ‘ঝড়পরধষ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ’ এবং ‘খধনড়ঁৎ গড়াবসবহঃ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ’ বই দু’টি বাংলা এবং ইংরেজীতে ছাপান এবং আমাদের কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করেন।” এছাড়া সুভাষ বসু, রাসবিহারী বসু, সুকর্ন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, বেনবেল্লা, লেনিন, মাও সেতুং, হো চি মিন ও চে গুয়েভারার জীবনী ও ডায়রি পড়তে বলা হতো। নানা দেশের বিপ্লব ও বিপ্লবী ইতিহাসের ওপর লেখা বই পড়তে উৎসাহিত করা হতো। (পৃষ্ঠা, ৬১-৬২) ‘জুলিয়াস ফুচিকের ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’, জন রিডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’, রেজিস দেবরের ‘রেভ্যুলেশন ইন দ্য রেভ্যুলেশন’, অশোক মেহতা ও লোহিয়ার ‘ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম’ পড়তে বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করা হতো।” (পৃষ্ঠা, ৬১) ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের সচেতন উদ্যোগ নিউক্লিয়াসের ছিল। সেজন্য, “’৬৮ সালে আমার (কাজী আরেফ) তত্ত্বাবধানে একটি ‘ছায়া ফোরাম’ গঠিত হয়। আমার সঙ্গে ছিল মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), আ স ম আবদুর রব, সাজাহান সিরাজ ও স্বপন কুমার চৌধুরী। পরে এই ফোরামে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ’৬৮ সালে মফিজুর রহমান খান, ও মোস্তাফিজুর রহমান, ’৬৯ সালে মাসুদ আহমেদ রুমি, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক এবং ’৭০ সালে হাসানুল হক ইনুকে। ‘নিউক্লিয়াসের’ সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন রফিকুল ইসলাম (লিটল কমরেড)।” (পৃষ্ঠা, ৬২) বাম সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কমরেড সম্বোধনের চল আছে। তা যে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাকামী অংশের সদস্যদের মধ্যে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি। এ সময় আরও অনেকের নাম পাওয়া যাচ্ছে যারা ঢাকা শহর, চট্টগ্রাম জেলা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ফোরামের দায়িত্ব পালন করেছেন নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি তথ্য দেন কাজী আরেফ। ‘১৯৭০ সালে এসে নিউক্লিয়াসের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খানের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠে সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক লীগ। শ্রমিক লীগ ’৭০ সালের ৭ জুন ‘জয় বাংলা বাহিনী’ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অভিবাদন জানানোর মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধকে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’ শ্রমিক লীগের নিউক্লিয়াসপন্থী হিসেবে পরিচিতদের নাম উল্লেখ করেছেন কাজী আরেফ। এদের মধ্যে ছিলেন, আবদুল মান্নান, মোহাম্মদ শাহজাহান, সায়েদুল হক সাদু, রুহুল আমিন ভুঁইয়াসহ আরও কয়েকজন। (পৃষ্ঠা ৬৫) ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, বা বিএলএফ ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক শাখাÑ এই পরিচ্ছদে কাজী আরেফ জানাচ্ছেন, “ ৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু বিএলএফের ‘হাইকমান্ডে’ শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন। তিনি এ চার যুব নেতাকে স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রয়োজনে ভারতের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন।” (পৃষ্ঠা ৬৫) দু’টো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই পরিচ্ছদে পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে : “বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ‘নিউক্লিয়াসের’ অন্যতম শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন।” ছাত্রদের ওপর বেগম মুজিবের দৃঢ় আস্থা জানা যায়, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখায়। ‘বেগম মুজিবের দৃঢ়তার কাছে ডানপন্থী আপোসকারীরা কুপোকাত হলেন’ রচনায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তুলে ধরেছেন কোন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নেতারা সাহসী হয়েছিলেন পাকিস্তানী পতাকার বদলে সংগ্রামী ছাত্র নেতাদের দ্বারা পরিকল্পিত সূর্য ও বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত পতাকা ওড়াতে। তিনি বলেন, “২৩ মার্চের আগের রাত পর্যন্ত বত্রিশ নম্বর বাড়িতে রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলেছে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ও এই পতাকা ওড়ানো নিয়ে। আওয়ামী লীগের ডানপন্থী নেতারা কিছুতেই জয়বাংলার পতাকা ওড়াতে রাজি নন। এর আগে রমনা বটতলার মাঠে জয়বাংলা সেøাগানকে জাতীয় সেøাগান হিসেবে গ্রহণেও তারা আপত্তি করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশের নেতাদের চাপে (এখন তাদের অধিকাংশই জাসদে আছেন) এদের আপত্তি টিকেনি। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের সঙ্গে। ২২ মার্চ রাত্রিতেও ঢাকার সাংবাদিকদের চোখে তাই ঘুম ছিল না। আওয়ামী লীগের কর্মসূচী জানার জন্য সকলে ব্যাকুল উদগ্রীব। বৈঠক চলছে। দলের তরুণ কর্মীরা উত্তেজিত। তারা জানালেন, প্রধান নেতারা পতাকা ওড়ানোসহ সক্রিয় আন্দোলনের কর্মসূচী নিতে রাজি নয়। বঙ্গবন্ধু তাদের বোঝাচ্ছেন। সম্ভবত বত্রিশ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বর্তমানের জাসদ নেতা এবং তখনকার বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুগত ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রবের সঙ্গে কথা বলছিলাম। রবও খুব উত্তেজিত। বললেন, ‘গাফ্ফার ভাই, আওয়ামী লীগ যদি প্রত্যক্ষ আন্দোলনের কর্মসূচী না দেয়, তাহলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই সংগ্রামের কর্মসূচী ঘোষণা করবে।’ ঠিক এমন সময় বিরাট এক ঝাঁটা হাতে বেগম মুজিবের আবির্ভাব। বললাম, ‘ভাবি, আপনার হাতে ঝাঁটা কেন?’ এ সময় ভেতরের কক্ষ থেকে দু’জন প্রধান আওয়ামী লীগ নেতাও বাইরে বেরুলেন। তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বেগম মুজিব বললেন, ‘ভাই, ঝাঁটা হাতে নিয়েছি তোমাদের জন্য। সেই সন্ধ্যা থেকে মিটিংয়ের রুম পাহারা দিচ্ছি। নেতাদের বলে দিয়েছি : ছেলেদের দাবি না মেনে মিটিং থেকে বেরুলে তাদের হাতে অপমান হওয়ার আগে আমিই নেতাদের ঝাঁটাপেটা করব।’ এই মহীয়সী মহিলার নীতিনিষ্ঠ ও দৃঢ়তায় আওয়ামী লীগের প্রধান ডানপন্থী নেতারা সেদিন পিছু হটেছিলেন। দ্বিতীয় তথ্যটি আওয়ামী লীগ সম্পর্কিত। এই বিষয়ে আরেফ লিখেছেন : “দলগতভাবে আওয়ামী লীগ ‘নিউক্লিয়াস’ সম্পর্কে অবহিত ছিল না।” (পৃষ্ঠা ৬৬) তবে জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত অনেকের নাম পাওয়া যায় যারা নিউক্লিয়াসের সমর্থক বা সহযোগী ছিলেন। এঁদের মধ্যে গাজী গোলাম মোস্তফা, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম, ফজলুল হক বিএসসি, আবদুল মোমেন, রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া, ফরিদ গাজী, শেখ আবদুল আজিজ, মোশাররফ হোসেন, সোহরাব হোসেন, ফণীভূষণ মজুমদার, সালাউদ্দিন ইউসুফ, আবদুর রব সেরনিয়াবত, বিধানকৃষ্ণ সেন, মানিক চৌধুরী, আব্দুর রহমান (শ্রমিক নেতা) আওয়ামীপন্থী রাজনীতির পরিচিত নেতা ছিলেন। (পৃষ্ঠা, ৬৬) তৃতীয় পর্ব “এ ঠিকানায় গেলেই তোমরা অস্ত্র, ট্রেনিং, ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতা ও ‘প্রবাসী সরকার’ গঠনের সকল সাহায্য পাবে।”Ñবঙ্গবন্ধু কাজী আরেফ জানাচ্ছেন, আওয়ামী লীগের বাইরেও ভাসানীপন্থী ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম, কাজী জাফর আহমেদ, আবদুল মান্নান ভুঁইয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড ফরহাদ ও সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক; শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের নির্মল সেন, সিদ্দিকুর রহমান ও মাওলানা সাইদুর রহমান; বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের রাশেদ খান মেনন, মোস্তফা জামাল হায়দার, হায়দার আকবর খান রনো ও মাহবুব উল্লাহÑ এঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। “উপরোক্ত সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ পরিচালিত ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনকে ‘এক দফা’ আন্দোলনে রূপান্তরিত ও বেগবান করার ক্ষেত্রে অনেকাংশে সহায়ক হয়।” (পৃষ্ঠা, ৬৭) শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, সাহিত্য-সংস্কৃতি-চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত আলোকিত মানুষজনের নাম আছে যারা ‘নিউক্লিয়াসের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসিমউদ্দীন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সিরাজউদ্দিন হোসেন, আসাফউদ্দৌলা রেজা, সত্যেন সেন, এনায়েতউল্লাহ খান, ফয়েজ আহমেদ, আবিদুর রহমান, কে জি মোস্তফা, এনএম হারুন,মাহবুব তালুকদার, গিয়াস কামাল চৌধুরী, আহমেদ ছফা, আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সমুদ্র গুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রাহাত খান, জহির রায়হান, এহতেশামসহ অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন কাজী আরেফ। ‘আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলার অভিযুক্ত কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন খুরশিদ, স্টুয়ার্ড মুজিবসহ ঐ মামলার প্রায়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিএলএফের কার্যক্রমের সমর্থক ছিলেন।’ (পৃষ্ঠা, ৬৭) ‘কেরানীগঞ্জ থানার কলাতিয়া গ্রামের রতন-গগন-মাখনদের বাড়িতে নিউক্লিয়াস-বিএলএফ সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের যে ব্যবস্থা করেছিল, তার মূল দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ।’ “সম্ভাব্য ‘জনযুদ্ধের’ সময়ে বেতার কেন্দ্র চালু রাখার জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক নুরুল্লাহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সমিটারটি চালু করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের পক্ষ হয়ে যোগাযোগ রাখার দায়িত্বে ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও এ বিষয়ে অধ্যাপক নুরুল্লাহর সাক্ষাত হয়েছিল।” (পৃষ্ঠা, ৬৮) ‘মুভি ক্যামেরায় জগন্নাথ হল গণহত্যা’ রচনায় ড. নূরুল উল্লাহ সেই ইতিহাস তুলে ধরেছেন। জনযুদ্ধের জন্য ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের’ পক্ষ থেকে সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের পরিকল্পনার কথা জানা যায় কাজী আরেফের লেখায়। ‘পরবর্তীকালে ’৭০ সালের আগস্টের দিকে আবারও ভারতে গেরিলা ট্রেনিংয়ে পাঠানোর জন্য ৬০ জন বিপ্লবী পরিষদ সদস্যকে মনোনীত করা হয়। ’৬৯ সালে শেখ মুজিব জেল থেকে বেরিয়েই চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন। ...তিনি ফিরে এসেই বিপ্লবী পরিষদের ফোরামে ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য কর্মী প্রস্তুত করার কথা বলেন। ’৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ৬০ জন্মের ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি এ সময় এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল যে আমরা বাধ্য হয়ে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার তারিখ পিছিয়ে দেই। ...’৭১ সালের ফেব্রুয়ারি বিএলএফের বার্তা নিয়ে ডাক্তার হেনা কলকাতায় চিত্তরঞ্জন সূতারের সঙ্গে দেখা করেন। শ্রী সূতার তখন শেখ মুজিবের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। ...ভারত বন্ধু হিসেবে সম্ভাব্য সকল সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। ...ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে মেজর জেনারেল সুজন সিং ওবানের সহায়তায় জনযুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে বিএলএফ সদস্যদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।’ (পৃষ্ঠা, ৭০-৭১) (চলবে)
×