ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শব্দ কিভাবে যুদ্ধাস্ত্র হয়ে উঠেছিল

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২৮ মার্চ ২০১৫

শব্দ কিভাবে যুদ্ধাস্ত্র  হয়ে উঠেছিল

... “From today Bangladesh is independent” (আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম)- পাঁচটি মাত্র শব্দ। এই শব্দ ক’টি ৪৪ বছর আগের এক স্বপ্ন পূরণের প্রথম প্রহরে বাঙালীর হৃদয়ে সাহসী আলোড়ন তুলেছিল; হাজার নদী-খাল-বিল, ঝড়-জলের নরম মৃত্তিকার বাংলাদেশ চৈত্রের কঠিন রূপ ধারণ করে পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তার বিরুদ্ধে দ্রোহের অস্ত্রহাতে তুলে নিয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মাত্র নয় মাসে হাসতে হাসতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালী, পাকিস্তানী হায়েনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল কয়েক লাখ বাঙালী মা-বোন। একজন মানুষের ডাকে একটি ঘোষণা এত অল্প সময় এত বড় আত্মত্যাগ, এতো নারী-পুরুষ, শিশু-যুবার জীবনদানের নজির বিশ্ব ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও না। এ যেন এক সম্মোহনী মন্ত্র। দেখতে দেখতে ৪৪ বছর পার হয়ে গেল। আমরা আজও কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। এ লেখা দু’দিন আগে ২৬ মার্চ ’৭১ বৃহস্পতিবার ছাপা হলে ভাল হতো। কিন্তু জনকণ্ঠে আমার নিয়মিত কলামের দিন প্রতি শনিবার। তাই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসÑ এ ছাপা না হলেও লেখাটি তৈরি করতে বসলাম স্বাধীনতা দিবসেই। এতদিন পর লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে, কত পড়ছে না, কত বহুরূপীর (জিয়া-একে খন্দকারের মতো) মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেছে। এভাবেই তো ইতিহাস তার সঠিক পথ আবিষ্কার করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয়, ‘জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কতো কথাই না মনে পড়িতেছে।’ যে সম্মোহনী মন্ত্রের কথা বলছিলাম তা বাঙালীর হাজার বছরের সংগ্রাম-আন্দোলন ও আত্মত্যাগের চূড়ান্ত পর্যায়ে (culmination) মন্ত্রটি (স্বাধীনতার ঘোষণা) শুনিয়েছিলেন বাঙালীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতি তাঁকে এ মন্ত্র উচ্চারণের সর্বময় এখতিয়ার বা ভোটের ম্যান্ডেট দিয়েছিল। ÔThis may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must be go on until the last soldier of the pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved” আগেই বলেছি, স্বাধীনতার এই ঘোষণা হাজার বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ‘কালমিনেশন’। বহু তপস্যার ধন বাঙালীর এই সন্তান আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার আগে ৭ মার্চ ৭১ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) এক কালজয়ী ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ এই কালজয়ী শব্দগুলোর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আহ্বান বা প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২৬ মার্চ দিলেন চূড়ান্ত ঘোষণা। ভাষণটি ছিল ১০৯৫ শব্দের এবং সম্পূর্ণ অলিখিত। ১৯ মিনিটে ভাষণটি শেষ করেছিলেন। ঐ ভাষণেই তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করার রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর একেকটি শব্দ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা ব্যবহার করেছি। আজও এ ভাষণ প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ৪শ’ বছর থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ আড়াই হাজার বছরের অল্প ক’টি উল্লেখযোগ্য ভাষণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। (গ্রন্থটি এখনও সংগ্রহ করতে পারেনি, হাতে এলে পরবর্তীতে এর ওপর আলোচনা করার ইচ্ছে আছে)। আমি বহুবার ভাষণটিকে ৯ মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। ভাষণে এমন কিছু বাক্য বা শব্দ আছে যা যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে আমরা ব্যবহার করেছি। যেমন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ এ বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা যে নির্দেশনাটি ৯ মাসের জন্য পেয়েছিলাম তা হলো প্রথমেই রেলপথ, সড়কপথ, নৌপথ অর্থাৎ পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তার চলাচলের রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবার এবং দিয়েও ছিলাম। চাঁদপুর-লাকসাম রেললাইনের মধুরোড রেল-পুলটি আমরা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম জহুরুল হক পাঠান, সুবেদার আবদুর রব (মরহুম)-এর নেতৃত্বে। আমাদের কমান্ডোরা চাঁদপুর ঘাটে একটি জাহাজও ডুবিয়ে দিয়েছিল। ঠিক তেমনি : ক. সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। খ. প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। গ. তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ঘ. পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। ঙ. আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। চ. প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। ছ. তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ বা ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ এ কথাগুলো তার ২৬ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায়ও এসেছে। “... যিবৎবাবৎ ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ রিঃয যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব ধৎসু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ...”-এর সফল বাস্তবায়ন আমরা দেখেছি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সাশিয়ালির যুদ্ধে। এই যুদ্ধে আমাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের মানুষ ‘যার যা ছিল তাই নিয়ে’ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তখন সময়টা ছিল বর্ষাকাল এবং মাঠে ছিল পানি। পাকিস্তানী আর্মি নৌকা করে গ্রামের ভেতরে ঢুকেছিল। মানুষ তাদের নৌকায় আক্রমণ চালিয়ে অনেককে হতাহত করেছিল। ‘আমরা পানিতে মারব’ এই অস্ত্র অর্থাৎ নৌকা ডুবিয়ে ‘পানিতেও মেরেছিল’। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম থেকে চাল-ডাল, মাছ-মাংস, শাক-সবজি কোন কিছু শহরে যেতে দেয়নি, অর্থাৎ এভাবে ‘ভাতে মারার’ যুদ্ধ চালিয়েছিল। এভাবে ৭ মার্চের ভাষণের একেকটি শব্দ একেকটি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আজ এত বছর পরও এই ভাষণটি কত সুদূরপ্রসারী কত প্রাসঙ্গিক লক্ষ্য করার বিষয়। এবার এই উপলব্ধিতে দেশের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছে। লাল-সবুজ রঙের শাড়ি-ব্লাউজ বা শার্ট-পাঞ্জাবি পরে মানুষ আগের রাত ১২টা ০১ মিনিট থেকে কর্মসূচী বাস্তবায়ন শুরু করে। ১৬ কোটি মানুষ স্বাধীনতা-বিরোধী এবং চক্রান্তকারী বোমাবাজ পেট্রোলবোমাবাজদের জানিয়ে দেয়Ñ ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। যার বাস্তব উদাহরণ হিসেবে দেখা গেছে খালেদা-তারেকের নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত বা ছাত্রদল-ছাত্র শিবিরের নাশকতাকে প্রতিরোধ করে চলেছে মানুষ। তাদের নাশকতার আগুন আজ স্তিমিত, পরাভূত। এভাবেই লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে বাঙালীর স্বাধীনতার মশাল এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে যাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তারই প্রতীকী এক অনুষ্ঠান হলো ২৬ মার্চ ১২টা ০১ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণস্থল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন চত্বরে, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের আয়োজনে। ফোরামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব লেখক-সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীবের আমন্ত্রণে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। আমরা ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা এ প্রজন্মের ৩১ জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী তরুণের হাতে জাতীয় পতাকা ও একই সংখ্যকের হাতে আলোর মশাল তুলে দেই। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল এগিয়ে নিয়ে যাবে। অনুষ্ঠানে সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) এম শফিউল্লাহ বীরউত্তম সংক্ষিপ্ত ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। এ ছাড়াও লে. কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী, লে. জেনারেল (অব) হারুনুর রশীদ, লেখক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা জব্বার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা ম. হামিদ, স্বাধীন বাংলা বেতার শিল্পী বুলবুল মহলানবিশ প্রমুখ অংশ নেন। আবু ওসমান চৌধুরী সকলকে শপথবাক্য পাঠ করান। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল সংগঠন মোমবাতি জ্বালিয়ে দিবসটি পালন করে। জাতীয় প্রেসক্লাবে আমরা স্বাধীনতার পক্ষের সাংবাদিক ইউনিয়ন ডিইউজের নেতৃত্বে রাত ১২টায় ২৫শে মার্চের কালরাত্রির অবসানে মোমবাতি প্রজ্বলন এবং আগামী দিনে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ঘোষণা করি। ঢাকা ॥ ২৬ মার্চ ২০১৫ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
×