ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুব্রত সেনগুপ্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৮ মার্চ ২০১৫

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী  সুব্রত সেনগুপ্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘রক্ত চাই রক্ত চাই অত্যাচারীর রক্ত চাই’/‘ছোটরে সবাই বাঁধ ভাঙ্গা বান অগণিত গ্রাম মজুর কিষাণ’/‘শোন জনতা গণ জনতা’- মুক্তিযুদ্ধের সময় এরকম অনেক কালজয়ী গান লিখেছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত। মা-মাটি ও বাংলাদেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিসংগ্রামে। অনেকটা অনাদর আর অবহেলায় কেটেছে জীবন। ১২ বছর ধরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় কেটেছে। তবুও এই গুণী মানুষটির খবরও রাখেনি কেউ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই কণ্ঠসৈনিক এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের ২১৪ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন তিনি। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হচ্ছে না তাঁর। দ্রুত তাঁকে দেশের বাইরে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বাঁচার স্বপ্ন দেখেন দেশপ্রেমিক এই মানুষটি। তাঁর চাওয়া একটাই। তা হলো জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন। সুস্থ হয়ে ফের দেশের জন্য লিখতে চান। ২১ ফেব্রুয়ারির ওপর রয়েছে ১৬০ গান আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন সাড়ে চার শ’ গান। আজ মৃত্যু তাঁকে তাড়া করে ফিরছে। তবুও দেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন অনেক। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, নতুন প্রজন্মের প্রতি আমার আহ্বান, তারা যেন আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে শেখে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত স্পাইনাল কর্ড, বক্ষ, নিউরো ও ইউরোলজি সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ আতিকুর রহমানের অধীনে আছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসার ভার বহন করতে পারছে না তার পরিবার। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। বলেন, অন্যের জন্য নিজেকে সারাজীবন বিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিয়তির কাছে হেরে যাচ্ছি। বড় স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এক যুগ ধরে কেবল নিজে সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। শেষ পর্যন্ত সেখানেও বোধ হয় ব্যর্থ হচ্ছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, টাকাকে আমার জীবনে কখনও অনিবার্য ভাবিনি। অথচ টাকার অভাবে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে আজ মনে হচ্ছে টাকাই মানুষের জীবনের চরম অনিবার্য। বলেন, আমি হয়ত আর বাঁচব না। মানুষ মরে যায় এটাই নিয়ম। আমিও মরে যাব। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় আমাকে মরতে হবে এটা ভেবে কষ্ট হয়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এমন করুণ পরিণতি দেখে মরতে হবে; তা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, আমার এরকম নির্মম পরিণতি হলে ভবিষ্যতে দেশের ক্রান্তিলগ্নে আর কি কেউ এগিয়ে আসবে? আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ভিক্ষা মানছি, তিনি যেন আমার সুচিকিৎসায় এগিয়ে আসেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করে আমার বেদনার কথাগুলো জানাতে চাই। বলেন, ‘আমি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাতি। আমার রক্তে বইছে বিপ্লবী চেতনার রক্ত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঢাকার সেগুনবাগিচায় ওস্তাদ বারীণ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে আমার ভেতরকার বিল্পবী চেতনা আরও উদ্দীপ্ত হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনারা যখন ঢাকাসহ সারাদেশে খুন-জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে, সাহস নিয়ে বিভিন্ন কৌশলে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকি। আমি পাগলের বেশে বিভিন্ন জায়গার খবর ও বোমা বহন করতাম। পরে যখন দেখলাম তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না, অনেক কষ্টে কসবা বর্ডার হয়ে ভারতের সোনামুড়ায় পৌঁছে আগরতলা শহরের কংগ্রেস ভবনে উঠলাম। সেখানে অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হলো। সেখান থেকে বলা হলো, যে বিষয়ে যে পারদর্শী তাকে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার আছে সুর, গান লেখার ক্ষমতা। কলকাতার ৫৭/৮ বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছলাম। অনেক গান আর কবিতা লিখেছি। আমার লেখা ‘রক্ত চাই রক্ত চাই অত্যাচারীর রক্ত চাই’ গানটির সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, ‘ছোটরে সবাই বাঁধ ভাঙ্গা বান অগণিত গ্রাম মজুর কিষাণ’ গানটির সুর করেছিলেন অনুপ ভট্টাচার্য, ‘শোন জনতা গণ জনতা’ গানটির সুর দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম তার পুরোটা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখন পরাজিত শত্রুরা আবার নতুন করে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টায় লিপ্ত। তিনি জানান, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রায় সাড়ে চার শ’ গান লিখেছি। কিন্তু আমার এ গান হয়ত কোনদিন কেউ শুনতে পারবে না। চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিাকে গানগুলো দেখানোর। কিন্তু আমার সে চেষ্টা সফল হয়নি। আমার দায়বদ্ধতা থেকে লিখেই চলেছি। সুব্রত সেনগুপ্তের স্ত্রী সঙ্গীতশিল্পী জোলি সেনগুপ্ত জানান, ডাক্তার জানিয়েছেন অবস্থা মোটেও ভাল নয়। নানা জটিল অপারেশনের প্রয়োজন কিন্তু এ দেশে সেটা সম্ভব নয়। এজন্য দেশের বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে পারলে হয়ত বাঁচানো সম্ভব হতো। বর্তমানে আমাদের পরিবারের অবস্থাটা হয়েছে এমন যে, এখানে অনেক ছাড় পাওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা খরচ চালাতে পারছি না। এ সময় তিনি সরকারসহ দেশের বিত্তবানদের কাছে আর্থিক সহায়তা কামনা করেন।
×