ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লাঙ্গলবন্দে প্রচণ্ড ভিড়ে ৭ নারী ও ৩ পুরুষ পদদলিত ॥ ১০ পুণ্যার্থী নিহত

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৮ মার্চ ২০১৫

লাঙ্গলবন্দে প্রচণ্ড ভিড়ে ৭ নারী ও ৩ পুরুষ পদদলিত ॥ ১০ পুণ্যার্থী নিহত

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে মহাষ্টমী পুণ্যস্নানে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে সাত নারীসহ ১০ পুণ্যার্থী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ২০। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটার দিকে রাজঘাট এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে নারীসহ দশজন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে মা-ছেলে, মা-মেয়ে ও এক কলেজশিক্ষক রয়েছেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টায় রাজঘাটে এ ঘটনা ঘটে। বাসস জানায়, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী পুণ্যস্নানে পদদলিত হয়ে দশজনের মৃত্যু ও অনেকের আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী মৃতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। পুণ্যার্থীদের অভিযোগ, সরু রাস্তায় চলাচলে শৃঙ্খলা না থাকায় এবং সেতু ভেঙ্গে পড়ার একটি গুজবকে কেন্দ্র করেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে নারীসহ দশজন নিহত হয়েছে। লাশ পরে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের তালিকায় নকুল চন্দ্র বিশ্বাস নামে এক কলেজশিক্ষক রয়েছেন। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, শুক্রবার ভোর পাঁচটা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে মহাঅষ্টমী স্নানের লগ্ন শুরু হওয়ার পর থেকেই পুণ্যার্থীদের ঢল নামে লাঙ্গলবন্দে। স্নানে অংশ নিতে এবার দেশের নানা প্রান্ত ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক পুণ্যার্থী আসে লাঙ্গলবন্দে। পুণ্যার্থীদের জন্য ১৬ ঘাটে স্নানের আয়োজন করে স্নান উদযাপন কমিটি। ১৬ স্নানঘাটের অন্যতম প্রধান রাজঘাটে স্নান করলে পুণ্য বেশি- এই বিশ্বাসে পুণ্যার্থীদের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা এবং এরমধ্যে লোহার বেইলি ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ার গুজবে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পুণ্যার্থীরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে পদদলিত হয়ে ঘটনাস্থলেই সাত নারী ও তিন পুরুষসহ দশ পুণ্যার্থী নিহত হয়। আহত হয়েছে আরও ২০ পুণ্যার্থী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিহত রাখির স্বামী রাজধানীর ঝিগাতলার জনি জানান, তাঁরা রাজঘাটে স্নান সম্পন্ন করে ফিরছিলেন। স্ত্রী রাখি এ সময় তাঁর হাত ধরা ছিল। হঠাৎ প্রচ- ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি ও দৌড়াদৌড়ি শুরু হলে স্ত্রী রাখি হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায়। এতে সে (রাখি) ও শাশুড়ি (রাখির মা) পড়ে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা যায়। অনেক চেষ্টা করেও তিনি তাদের বাঁচাতে পারেননি। অপর প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদির জানান, সকাল থেকে পুণ্যার্থীদের ঢল ছিল অন্যান্যবারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল রাজঘাট, অন্নপূর্ণা ও গান্ধী ঘাটে। তিনি জানান, একদিকে রাস্তা সরু, বেইলি সেতু তার চেয়েও বেশি সরু। রাজঘাটের সামনে ঢোল বাদ্য নিয়ে আসছিল ইস্্কন নামের একটি সংগঠনের কিছু লোক। এ সময় যাঁরা স্নান সেরে ফিরছিলেন হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে তাঁদের মধ্যে সাত নারী ও তিন পুরুষসহ দশ পুণ্যার্থী নিহত হয়। আহত হয়েছে আরও ২০ পুণ্যার্থী। তাদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পদদলিতর ঘটনার পর রাজঘাট এলাকার মোড়ের সড়কে শত শত জুতো, এক নারীর মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন চুল, শাড়িকাপড়সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে। রাজঘাট তখন ছিল লোকে লোকারণ্য। এতে বিশৃঙ্খল সৃষ্টি হতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুণ্যার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, লাঙ্গলবন্দে প্রতি বছর মহাতীর্থ স্নান উৎসব হলেও ব্রহ্মপুত্র নদের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। স্নানঘাটগুলোতে কচুরিপানা ও কাদাপানি ছিল। নদটি যথাযথভাবে খনন না করায় গভীরতা কমে যাওয়ায় এই কাদাপানির সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মহিলাদের কাপড় বদলানোর ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল না। ছিল না গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জরুরী ভিত্তিতে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও। অন্যদিকে স্নানকে কেন্দ্র করে পুণ্যার্থীদের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া দুই থেকে তিনগুণ বেশি নেয়া হয়েছে। নিহতরা হলো- মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের বলাই দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৭০), তার ছেলে নিত্য গোপাল দাস, ঢাকার ঝিগাতলার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতী দাস (৬০), তার মেয়ে লালবাগের শেখ সাহেব বাজার এলাকার জনি দাসের স্ত্রী রাহী দাস (২৫), মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগিরা গ্রামের নন্দগিরি সাহার ছেলে স্থানীয় চরমুগিয়া সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষক নকুল সাহা (৫০), কুমিল্লার দাউদকান্দির পরিমল সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫২), নোয়াখালীর কবিরহাটের অনিল নাথের স্ত্রী ভানুমতি নাথ (৫০), কুমিল্লার চান্দিনার রামচন্দ্রপুরের কালীপদ নন্দীর ছেলে রণজিৎ নন্দী (৫৫), মুরাদনগরের পরিমল দেবনাথের স্ত্রী তুলসী দেবনাথ (৫৫) এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার লোহালিয়া গ্রামের দ্বিজেন্দ্রলাল সেনের স্ত্রী সুচিত্রা সেন (৫০)। এদিকে ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব চক্রবর্তী জানান, কালভার্টের সামনে পুণ্যার্থীদের ঢল নামার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়। রাস্তা ও লোহার কালভার্টটি সরু এবং সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা ও লোহার কালর্ভাটটি প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন। বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোকাররম হোসেন জানান, স্নান শুরুর পর থেকে ভিড়ের চাপে রাজঘাটে ওই দুর্ঘটনায় দশজন মারা গেছে। আগে থেকে সহস্রাধিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে এই ঘটনার পরে প্রতিটি ঘাটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তার মাঝখানে পুলিশ সদস্যরা নিজেরা মানবঢাল তৈরি করে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, এই দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমানের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। পুণ্যার্থীরা যাতে সুশৃঙ্খল পরিবেশে স্নান সম্পন্ন করতে পারে সেজন্য প্রশাসন ও পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা জানান, সবরকম প্রস্তুতি নেয়ার পরেও সরকারী ছুটির দিনের সঙ্গে পুণ্য তিথিতে যোগ হওয়ায় পুণ্যার্থীদের ঢল বেশি হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। লাশ এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ইশরাত হোসেন খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান। তাদের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্নানের লগ্ন শেষ হবে শনিবার সকাল ছয়টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে বলে জানিয়েছেন স্নান উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব চক্রবর্তী। লাঙ্গলবন্দ স্নানের ইতিকথা ॥ লাঙ্গলবন্দ স্নান এবং নদের উৎপত্তি সম্পর্কে চমৎকার এক কাহিনী প্রচলিত আছে। পুরাণ মতে, যমদগ্নি নামে এক মুনি পিতৃভক্তি পরীক্ষা করার জন্য তাঁর চার ছেলেকে তাদের মা রেনুকাকে হত্যা করার আদেশ দেন। চার ছেলে এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরাম কুঠার দিয়ে মাকে দ্বিখ-িত করে। মাতৃহত্যার শাস্তিস্বরূপ কুঠার তার হাতেই লেগে থাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও কুঠার হাত থেকে ছাড়ানো যায়নি। মাতৃহত্যার পাপে আক্রান্ত হয় পরশুরাম। এ পর্যায়ে পিতা পরশুরামকে তীর্থ ভ্রমণের আদেশ দেন। যে তীর্থে তার হাতের কুঠার খসে পড়বে, সে স্থানই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান। এরপর পরশুরাম তার কুঠার লাঙ্গলবন্ধ করে পর্বতের মধ্য দিয়ে চালাতে থাকেন। সেই লাঙ্গলের ফলায় তৈরি পথ ধরে সৃষ্টি হয় ব্রহ্মপুত্র নদের। ওই পথ ধরে চলতে থাকে পরশুরাম নিজেও। এভাবে অনেক দিন পর নারায়ণগঞ্জের বর্তমান স্নানঘাটে এসে লাঙ্গলটি আটকে যায়। হিমালয় থেকে বয়ে আসা ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ওই স্থানে স্নান করে পাপমুক্তি ঘটে পরশুরামের। খসে পড়ে হাতের কুঠার। পরশুরামের লাঙ্গলের ফলা থেমে যাওয়া বা বন্ধ হওয়া থেকেই এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্ধ। কালক্রমে তা স্থানীয়দের উচ্চারণ বিবর্তনে হয়ে ওঠে লাঙ্গলবন্দ। সেই থেকে পুণ্যার্থীদের কাছে স্থানটি লাঙ্গলবন্দ নামেই পরিচিত।
×