ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশী দমন-পীড়নের অভিযোগ ॥ হাইকমিশন কোন পদক্ষেপ নেয়নি

মালদ্বীপে গ্রেফতার আতঙ্কে বাংলাদেশীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৭ মার্চ ২০১৫

মালদ্বীপে গ্রেফতার আতঙ্কে বাংলাদেশীরা

ফিরোজ মান্না ॥ মালদ্বীপে বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর পুলিশী দমন-পীড়ন চলছে। গত এক সপ্তাহের মালদ্বীপে দুই বাংলাদেশী খুন ও দুইজনকে ছুরি মেরে আহত করার প্রতিবাদ করায় পুলিশ বাংলাদেশীদের ওপর এই দমন অভিযানে নেমেছে। দেশটি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী কর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছে, খুনের ঘটনা নিয়ে আর কোন প্রতিবাদ বিক্ষোভ করলে ভিসা বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই হুমকির পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশী কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পুলিশের ভয়ে অনেক কর্মী মুখ বন্ধ করছে। কিন্তু আবার অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। তারা মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে আজ শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। খুনের ঘটনাটি হাইকমিশন গুরুত্ব না দেয়ায় বাংলাদেশী কর্মীরা এ কর্মসূচী পালন করবে। মালদ্বীপে বর্তমানে বৈধ অবৈধ ৭০-৮০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী কাজ করেন। এদিকে মালদ্বীপ থেকে রাজিব নামের এক কর্মী টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর দেশটির পুলিশ এমন দমন-পীড়ন নির্যাতন ক্রমাগত করে যাচ্ছে। গত রবিবার ভোরে চার মুখোশধারীর হামলায় প্রবাসী বাংলাদেশী শাহীন মিয়া খুন হন। শাহীন মালের সাউথ-ওয়েস্ট হারবার এলাকায় ‘লিয়ানু ক্যাফে’তে কাজ করতেন। আর ‘আলিফ আলিফ আতোল থড্ডু’ দ্বীপ থেকে বিল্লাল নামে অন্য এক বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে বিষয়টি নিয়ে কর্মীরা প্রতিবাদমুখী হয়ে ওঠে। তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত ১০টার দিকে বিল্লালের ঘরে তার চাকরিদাতা হোসেইন হাসান লাশটি দেখতে পান। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ সেখান থেকে বিল্লালের লাশ উদ্ধার করে। বিল্লালের সঙ্গে ওই বাসায় আরও তিনজন প্রবাসী থাকতেন। মালদ্বীপ থেকে কয়েকজন কর্মী অভিযোগ করেন, দেশটির পুলিশ মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোন কথাই বলেনি। এছাড়া এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি। অন্যদিকে শাহিন মিয়া খুনের বিষয়েও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করার চেষ্টাও করেনি। মালদ্বীপ গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর আরও তিনটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাভিরি হিংগুনের টেপকন হার্ডওয়ারের সামনে অজ্ঞাত কয়েকজন এক বাংলাদেশী কর্মীর ওপর আক্রমণ করে। এতে ওই কর্মী মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনার একটু পরই একই এলাকায় আরেকজন বাংলাদেশী কর্মীর ওপর হামলা চালিয়ে আহত করে। একই দিন এক ভারতীয় কর্মীকে ছুরি মারা হয়। এই তিন ঘটনারও কোন প্রকার ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এ কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ক্ষোভে ফুসে ওঠে। তারা কয়েক দফা বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঘটনার প্রতিবাদে স্মারকলিপি দিয়েছেন। হাইকমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এতে বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে আরও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। কর্মীরা পৃথক ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করলে পুলিশ বাংলাদেশী কর্মীদের ওপর কঠোর অবস্থান নেয়। পুলিশ বাংলাদেশী কর্মীদের ভিসা বাতিলসহ দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেয়। বিষয়টি মালদ্বীপ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মালদ্বীপের অনলাইন নিউজ পেপার হাভেরুকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই তিন প্রবাসীর ওপর হামলার সঙ্গে শাহীন মিয়া হত্যাকা-ের কোন যোগাযোগ আছে কি না তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। শাহীনকে হত্যার আগের দিন রাতে একদল যুবক ওই ক্যাফেতে গিয়ে বিনা পয়সায় কফি চাইলে কর্মীদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। পরে ওই যুবকরা ক্যাফেতে ভাংচুর চালায়। এ ঘটনার পরদিন শাহীন মিয়া খুন হন। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন হামলার ঘটনায় সেখানে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের দশজন মতো কর্মী খুন হয়েছেন। মালদ্বীপ প্রবাসী রাজিব জানিয়েছে, নিরাপত্তার দাবিতে আজ শুক্রবার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে এ সমাবেশ না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশী কর্মীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করার বিষয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অনড় রয়েছে। পুলিশের সতর্ক করার বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা প্রতিবাদ করার কর্মসূচী পালনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে এ কর্মসূচী হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে মালদ্বীপের ইমিগ্রেশন কন্ট্রোলার মোহামেদ আনওয়ার এ বিষয়ে প্রবাসীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ওয়ার্ক পারমিটের শর্ত অনুযায়ী তারা এ ধরনের কোন কর্মসূচীতে অংশ নিতে পারে না। এরপরও যদি কোন প্রবাসী এ ধরনের কাজ করে তাহলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকমিশনকে জানিয়েছে দিয়েছে। যদি কোন কর্মী বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করে তাহলে তাদের ভিসা করা হবে। মালদ্বীপের এমন পরিস্থিতির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কোন দেশে কাজ করতে গিয়ে বিক্ষোভের মতো কর্মসূচী পালন করতে পারে না। তাদের ওয়ার্ক পারমিটে এ ধরনের শর্ত দিয়েই তাদের চাকরি নিয়ে যেতে হয়েছে। এরপরও মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে বিষয়টি দেখার জন্য বলা হয়েছে। এদিকে মালদ্বীপের বিষয়টি জানার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মালদ্বীপে যেসব কর্মী কাজ করেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত। যারা দোকান ও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তারাই কেবল বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে। বিষয়টি দেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখছে। এদিকে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মালদ্বীপে দুই বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় সে দেশের সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। এ বিষয়ে বুধবার দেশটির রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সঙ্গে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশনার রিয়ার এ্যাডমিরাল কাজী সারোয়ার হোসেন সাক্ষাত করে সেদেশে অবস্থিত সকল বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার দাবি জানান। মালদ্বীপ সরকার সেখানের বাংলাদেশের সকল নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আশ্বাস দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মালদ্বীপে দুজন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। এদের একজন হলেন শাহীন মিয়া। অপরজন বেলাল। এই দুই বাংলাদেশী নাগরিক মারা যাওয়ার পরে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশনার দেশটির রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিনের কাছে সাক্ষাত করেন। বৈঠকে মালদ্বীপের হাইকমিশনার বাংলাদেশী নাগরিক হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার দাবি জানান। রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনারকে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া এই ঘটনায় সেখানের বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে হাইকমিশনার তাদের শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শাহীন মিয়া গত ২২ মার্চ একটি সাইবার ক্যাফেতে নিহত হয়েছেন। আর গত ২৩ মার্চ মালদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকা তুরধু দ্বীপে বেলালের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় মালদ্বীপের হাইকমিশনের সঙ্গে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
×