ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

২৭ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয়

ঠাকুরগাঁওয়ে একাত্তরের প্রথম শহীদ রিক্সাচালক মোহাম্মদ আলী

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২৭ মার্চ ২০১৫

ঠাকুরগাঁওয়ে একাত্তরের প্রথম শহীদ রিক্সাচালক মোহাম্মদ আলী

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও, ২৬ মার্চ ॥ ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল ঠাকুরগাঁওয়ের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি রক্তঝরা দিন। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এ দিনটির কথা। ওই দিন স্বাধীনতার পক্ষে জয়বাংলা বলে স্লোগান দেয়ার অপরাধে হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় রিক্সাচালক মোহাম্মদ আলীকে। সেদিন ঠাকুরগাঁও শহরে বলবত ছিল সান্ধ্য আইন। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে বিচ্ছিন্নভাবে শহরে মিছিল চলে। অনেকেই ভিড় করে আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল করিমের বাসার সামনে। সে সময় ফজলুল করিম ছিলেন জেলা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল। কিন্তু ২৬ এবং ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের জনসাধারণ এ বিষয়ে কোন সংবাদই পায়নি। সান্ধ্য আইন জারি থাকলেও ঠাকুরগাঁওবাসী অন্যান্য দিনের মতো ২৭ মার্চেও খ- মিছিলে শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দেয়। দুপুরে একটি মিছিল জয়বাংলাসহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায় ইপিআর ক্যাম্পের দিকে। আর একটি ছোট মিছিল শহরের কালীবাড়ি মোড়ের সামনে পৌঁছলে দক্ষিণ দিক থেকে ইপিআরবোঝাই একটি লরি ও জিপ এসে থামে। জিপ থেকে নামে ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। সামনে হানাদার বাহিনীকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে ছোট মিছিলটি। মিছিলের সামনেই দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠকণ্ঠে- মুখে চাপদাড়ি মধ্য বয়সের রিক্সাচালক মোহাম্মদ আলী বুক ফুলিয়ে মোহাম্মদ আলী বলে উঠেন জয়বাংলা। মেজর মোহাম্মদ হোসেনের ইশারায় হানাদারের রাইফেল গর্জে ওঠে। মুহূর্তে চিৎকার দিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মোহাম্মদ আলী। মিছিলের বাকি লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটে পালিয়ে যায়। পাকা রাস্তার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মোহাম্মদ আলীর লাশ। কেউ কেউ অবশ্য বলে খ- মিছিলটি হঠাৎ ইপিআরের গাড়ির সামনে পড়ে যায়। বিনা উস্কানিতে ইপিআর বাহিনী মোহাম্মদ আলীকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। মোহাম্মদ আলী নিহত হওয়ার পর মেজর তার জিপ ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফিরে যায় ইপিআর ক্যাম্পে। ধীরে ধীরে একজন দুইজন করে লোক ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল মোহাম্মদ আলী নিহত হওয়ার খবর। ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাসে হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। ঘর থেকে বের হয়ে আসে লোকজন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তখন সকলেই এক হয়ে সংগ্রাম করছে। তাই লোকজন সব ভয় ঝেড়ে ফেলে একত্রিত হয় মোহাম্মদ আলীর নিহত হওয়ার স্থানে। তড়িঘড়ি করে রাস্তার পাশেই মোহাম্মদ আলীর লাশ দাফন করা হয়। তাঁর নামানুসারে স্বাধীনতার পর এ রাস্তার নামকরণ করা হয় শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়ক। পরদিন ২৮ মার্চ আবার কেঁপে উঠে ঠাকুরগাঁও শহর। হানাদারের বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় কিশোর নরেশ চৌহানের বুক। বাঁশের বেড়ায় ঘরের ভেতর থেকে কিশোর নরেশ জয়বাংলা বলে চিৎকার করছিল। সঙ্গে সঙ্গে হানাদার বাহিনী সেই ঘর লক্ষ্য করে গুলি করে। নরেশ চৌহানের নামানুসারে তার বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম বর্তমানে শহীদ নরেশ চৌহান সড়ক। এ রাস্তার পাশেই নরেশ চৌহানকে কবর দেয়া হয়। ওই দিন ২৮ মার্চ রাতেই ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালী সেনাদের অভ্যুথানের সময় আরও ৩ জন নিহত বাঙালী ইপিআরকে সমাধিস্থ করা হয় মোহাম্মদ আলীর কবরের পাশে।
×