ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৭ মার্চ ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধ পক্ষ ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দল। ভারত বিদ্বেষ ও হিন্দু বিদ্বেষই ওদের একমাত্র রাজনীতি। আর এই নীতি নিয়ে ফুরিয়ে যাওয়া মুসলিম লীগের শূন্যস্থান পূরণ করেছে বিএনপি। চেতনায় যাদের পাকিস্তানী মানসধারা সব সময় ক্রিয়ারত। আইয়ুব খানের প্রেতাত্মার মতোই ক্ষমতা দখল করে তারপর রাজনৈতিক দল গঠন করেছে বিদ্যমান স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে। বিএনপি ও জামায়াত পরস্পর পরস্পরের একীভূত আজ এদেশে। এরা বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনীতির উদ্ভব কামনা করে না। স্বাধীনতার ইতিহাসকে প্রতিমুহূর্তে বিকৃত করে আসছে। স্বাধীনতার স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই জুটি দল দু’টি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী মহল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ইয়াহিয়াকে সরিয়ে এই পদ গ্রহণ করে একাত্তরের ডিসেম্বরে বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কোনভাবে কনফেডারেশন করা যায় কি-না। বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। কিন্তু পাকিস্তান তার এই অবস্থান থেকে আজও সরে আসেনি। ভুট্টোর ১৯৭৪ সালে ঢাকা সফর ও কতিপয় রাজনীতিকের সঙ্গে বৈঠকের পর এই তৎপরতা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে চীনাপন্থী দল, উপদল ও গ্রুপগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ধ্বংসে লিপ্ত হয়। থানা-ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্র লুট, খাদ্য ও পাট গুদামে আগুনসহ নাশকতামূলক সব কাজই করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা পাকিস্তানের সহায়তা পেয়েছে। ভুট্টোর জীবনীতে রয়েছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির’ নেতা আব্দুল হক ভুট্টোর কাছে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য চেয়ে পত্র পাঠান। যা ছাপা হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানী চেতনার দরোজাটা খুলে দিলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দেয়। বাস্তবতা যে, পঁচাত্তর পরবর্তী যে সকল বাংলাদেশবিরোধী লোক সমাজ ও রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তারা এখনো স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেনি আলবদর, আলশামস ও রাজাকার এবং শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীও। ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য যারা জাতির কাছে ক্ষমাভিক্ষা করেনি, তারা এদেশে এখনও রাজনীতি করছে শুধু নয়, অর্থ, অস্ত্রসহ নানাবলে বলীয়ান। হেড অফিস পাকিস্তানে রেখে এবং অন্তরে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়েই তারা বাংলাদেশে রাজনীতি শুধু নয়, পাকিস্তানীমনা খালেদার বদৌলতে সরকারের মন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতো। ১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মাঠে নামে। ‘পরাজয়ের গ্লানি’ তারা মুছতে চায়। কিন্তু বাস্তবে তা মোছার নয়। ভুট্টোর পরামর্শে, আইএসআইয়ের পরিকল্পনায় তারা পরাজয়ের পর পরই বাংলাদেশ নামটি মুছে দিতে সক্রিয় হয়। পাকিস্তানীদের মতো ধর্মকে বর্ম করার আড়ালে বাঙালীকে নির্মূল করাই লক্ষ্য। স্বাধীন একটি জাতিকে পরাধীনতার শেকলে বেঁধে ফেলাই উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে তাদের হাতিয়ার হয়েছে জামায়াতে ইসলামী দলটি। সম্ভবত পাকিস্তানের পতন টের পেয়ে গোলাম আযম, মওলানা আবদুর রহিম ও একেএম ইউসুফ এই তিন জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান চলে যায়। ১ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণী মুক্ত করা দরকার জাতীয় পরামর্শ দেয় এবং বদর বাহিনী ও রাজাকারের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবও রেখেছিল। তাছাড়া ১৬ ডিসেম্বর ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ’-এর বৈঠক ডাকার অনুরোধ জানায়। পরবর্তীকালে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যান এবং সেখান থেকে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানে ভুট্টো শেষবারের মতো কনফেডারেশন করার বিষয়টি উত্থাপন করলেও সাড়া পাননি। ১৯৭১ এর ২০ ডিসেম্বর পাকি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে প্রথম ভাষণেই ‘ভাঙা পাকিস্তানকে’ জোড়া লাগানোর আবেদন জানিয়ে ভুট্টো বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান আমাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা এদেশের বৃহদাংশ। আমি নিশ্চিত তারা আমাদের সঙ্গে একসাথে বাস করতে চায়। আমি তাদের কাছে আবেদন করছি, তারা যেন আমাদের ভুলে না যায়। তবে তারা যদি ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে তারা যেন আমাদের ক্ষমা করে।’ ১৯৭২ সালের পুরো সময় জুড়েই দাবি করেন ভারতের দখলীকৃত এলাকা পাকিস্তানের অংশ। বঙ্গবন্ধু মুক্ত হওয়ার পর গোলাম আযম লাহোরে বসে গঠন করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। গোলাম আযমের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বাঙালী ও বিহারী অধ্যুষিত স্থানে মিছিল, সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচী পালন করা হয়। ভুট্টো এই কমিটিকে তাঁরও লক্ষ্য পূরণে কাজে লাগান এবং অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। এরপর গোলাম আযম মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন লাভ ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাতে সফর শুরু করেন। পাকিস্তানী পাসপোর্টে পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে তিনি বক্তৃতাবাজি চালু করেন। পুনরুদ্ধার কমিটি পাকিস্তানে প্রচারণা চালাতে থাকে। তারা রেডিও পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য একটি প্রোপাগা-ামূলক বেতার প্রচারণা চালু করে বাংলা ভাষায়। পাকিস্তান সরকারও যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে না পারে সেজন্য জামায়াতের মজলিসে শূরায় গোলাম আযম প্রস্তাব পাস করান। ১৯৭২ সালের নবেম্বরে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার জন্য আইএসআইয়ের সহায়তায় পাকিস্তান ত্যাগ করেন গোলাম আযম। সৌদি আরব গিয়ে তিনি সৌদি বাদশাহকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য। সেখানে ইসলাম ধর্ম বিনষ্ট হচ্ছে। তাঁর প্ররোচনায় সৌদি সরকার ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকে কোন হজযাত্রী যেতে দেয়নি। সৌদি বাদশাহ পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে আর্থিক সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করেন। গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথমে কনফেডারেশন গঠন ও ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণার আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেয়ার প্রস্তাবও করেন। দেখা যায়, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মুসলিম যুব সংস্থা আয়োজিত ইসলামী যুব সম্মেলনে ভাষণে গোলাম আযম স্পষ্ট করে বলেন, হিন্দুস্তান দখল করে নিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে। মসজিদগুলো মন্দিরে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের মার্চে গোলাম আযম সৌদি আরব হতে লিবিয়া যান। বেনগাজীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে হাজির হন। মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছে ধর্ণা দেন এবং বাংলাদেশ যে ভারতীয়দের দখলে একটি অঙ্গরাজ্য এবং ইসলাম বিপন্ন, মসজিদগুলো মন্দির হয়ে গেছে ইত্যাকার মিথ্যা ও বানোয়াট বিষয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার ও সেখানকার মুসলিমদের উদ্ধারে সহায়তা চান। গোলাম আযম বাংলাদেশে তাঁর অনুসারীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে বলে তাঁদের জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে গোলাম আযম লিবিয়াতে যান। ত্রিপলীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইসলামী যুব সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য রেখে ভাষা ও ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা করে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা দেন। এই বক্তব্যের ক’মাস আগে ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান। ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের’ নামে সংগৃহীত অর্থে লন্ডনে বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবেই। লন্ডনে স্থাপন করেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির সদর দফতর। লন্ডনের ম্যানচেস্টারে ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট ইসলামিক সোসাইটি গঠন করেন এবং এর বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম পালন করা যায় না বলে নানা বানোয়াট যুক্তি তথ্য দিয়ে শ্রেতাদের সম্মোহিত করেন। সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে’ আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়। লন্ডনে অন্য মুসলিম দেশগুলোর সন্ত্রাসবাদী দলের নেতাদের সঙ্গেও গোলাম আযম মতবিনিময় চালাতেন। লন্ডনে তিনি বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সমাবেশে অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭৩ সালের আগস্টে ব্রিটিশ ইসলামিক মিশনের লোটারে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব উস্কে দেন। ইসলামী আন্দোলন করার কারণে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে বলে সহমর্মিতা লাভ করেন। আর আর্থিক সহায়তা পেতে থাকেন। ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার’ তহবিল সংগ্রহে গোলাম আযম বিভিন্ন সমাবেশে যোগ দিতে থাকেন। ১৯৭৩ সালের ৩১ আগস্ট হতে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মুসলিম স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা এ্যান্ড কানাডা আয়েজিত একাদশ বার্ষিক কনভেনশনে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখার সুযোগ নিয়ে তাঁর দেশকে পুনরুদ্ধারে সবার সহায়তা চান। টানা তিন সপ্তাহ ধরে গোলাম আযম যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইসলামী কেন্দ্র ও সংস্থায় ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানান এবং দেশটি উদ্ধারে আর্থিক সহায়তা চান। বিশাল অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করেন গোলাম আযম। ১৯৭৪ সালের গোড়ায় পূর্ব লন্ডনের একটি বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গোলাম আযম তাঁর বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার নীলনকশা পেশ করেন। বৈঠকে বাঙালী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক ও একাত্তরের কোলাবরেটররা উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্যে ছিল এটি সাদী, আলী হোসেন, ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিন, মাহমুদ আলী, মোহর আলী, ড. তালুকদার প্রমুখ। মাহমুদ আলী তখন ভুট্টো সরকারের ‘পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ক’ মন্ত্রী। এই বৈঠকে গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘লন্ডনে বসে আমাদের কাজ চালানো কঠিন হবে। তাই দেশে যেতে হবে। কাউকে ঝুঁকি নিতে হবে। তা না হলে কিছু হবে না। অবশ্য আপনারা দেশে গেলে লোক পাবেন, আমি যোগাযোগ করেছি। সবই ঠিক আছে।’ একটা ছাপানো লিফলেট বিতরণ করে আযম ব্যাখ্যা দেন যে, ‘এই লিফলেট গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের সঙ্গে জনগণ রয়েছে।’ এই লিফলেটে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের উল্লেখ ছিল। লিফলেটসহ কয়েকজন জামায়াতী সে সময় ঢাকার কেরানীগঞ্জে ধরা পড়েছিল। এই লিফলেটে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য ‘মসজিদে মসজিদে তৎপরতা শুরু করার’ আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই বৈঠকে গোলাম আযম মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও পাকিস্তান সরকারের সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘টাকার কোন অভাব হবে না। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আপনারা কাজ করে যান।’ কিভাবে কাজ করতে হবে, তার একটা রূপরেখাও দেন তিনি। ‘বুদ্ধিজীবি মহলে’ জামায়াত সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরা, ইসলাম বিষয়ক বইপত্র প্রকাশ করার পাশাপাশি জনগণের যে কোন আন্দোলনে সমর্থন দান। প্রয়োজনে নাশকতা বা টাকা-পয়সা ছড়িয়ে আন্দোলনকে বেগবান ও ব্যাপক করতে হবে। দীর্ঘ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় রূপরেখা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সাসহ কাগজপত্র নিয়ে দু’জন সদস্য বাংলাদেশ যাবে। ১৯৭৭ সালের ৩০ জুলাই এই গ্রুপটি পুনরায় বৈঠকে মিলিত হয় লন্ডনের হোলি ট্রেনিং চার্চ কলেজে। এখানে গোলাম আযমই ছিলেন প্রধান বক্তা। সভায় লক্ষ্মীপুরের মওলানা নাসিরুদ্দিন আহমদ গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বহালের দাবিতে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচার চালানোর প্রস্তাব রাখেন। এই নাসিরুদ্দিনকে ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশবিরোধী জনমত সংগ্রহের উদ্দেশে বিভিন্ন দেশে পাঠায় গোলাম আযমের অনুরোধে। জামায়াত নেতা নাসির ১৯৭২ সালে লন্ডনে ঘাঁটি গাড়ে। একই সময়ে গোলাম আযমের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন পাকিস্তানের প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী আলতাফ গওহর ও তৎকালীন পিপিআই প্রধান মোয়াজ্জেম আলী। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর গোলাম আযম তার রূপরেখা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে আসার তৎপরতা চালান। মুশতাকের কাছে জামায়াতীরা ধরনা দিলেও গোলাম আযমকে তিনি ফিরে আসতে দিতে রাজী হননি। এরপর সামরিক জান্তা শাসক জিয়ার কাছে আবেদন জানালেও জিয়া গড়িমসি করেন শুরুতে। তখন গোলাম আযম তার নাগরিকত্ব ফেরতসহ বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার দাবি করেন। ১৯৭৭সালে পাকিস্তান সফরকালে জান্তাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ লাভ করেন। করাচী বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক মুন্সী আহমদ ‘পাকিস্তান এন্ড বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই সফরের পর স্পষ্ট বোঝা গেল, দুই দেশের মানুষ মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হতে কতটা আগ্রহী। দুই দেশের সম্পর্কে এতদিন যে অসদ্ভাব বজায় ছিল,জিয়া ক্ষমতায় আসার ফলে তার জায়গায় এক নতুন সম্পর্কের সূচনা হলো।’ এই সফরের পর শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটি বোয়িং-৭০৭ বিমান ও ২৮টি রেলওয়ে বগি উপহার দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে গোলাম আযম লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইসলামিক কাউন্সিল অব ইউরোপ আয়োজিত ইসলামী সম্মেলনে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিতে বলেন। ডিসেম্বরে সৌদি আরবে ইবনে সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আইন সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের ভারতের হাত থেকে রক্ষার জন্য মুসলিম বিশ্বের সহায়তা কামনা করেন। লিফলেট বিতরণ করেন। গোলাম আযম ১৯৭৭ সালের জুলাইয়ে মক্কার কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষার পথ রুদ্ধ বলে বানোয়াট বর্ণনা দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারে বাংলাদেশকে চাপ দিতে ও মাদ্রাসাগুলোকে আর্থিক সহায়তা দানের আবেদন জানান। গোলাম আযম ১৯৮০ সালে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘বিদেশে অবস্থানকালে যেখানেই গিয়েছি সেখানে আমি বাংলাদেশে ইসলামকে কোন শক্তি দাবিয়ে রাখতে পারবে না এবং এখানকার মুসলমানরা ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বরদাশত করতে রাজি হবে না বলে মুসলিম বিশ্বকে নিশ্চয়তা দিয়েছি। তবে যাতে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম প্রত্যাহার করা হয় এবং ইসলামের কাজ করতে যেসব বাধা আছে তা দূর করা হয়, সে উদ্দেশ্যে মুসলিম জাহান ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের আবেদন জানিয়েছি।’ ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া পাকিস্তানে পাঁচদিন সফর করেন। সে সময়ে যে কনফেডারেশনের পক্ষে দাসখত দিয়ে আসেননি, তার নিশ্চয়তা কী? এর আগে ২০০২ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় বেড়াতে আসেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ভোজসভায় বেগম খালেদা বলেন, আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই এবং ভাইয়ের মত একযোগে কাজ করতে চাই। ভবিষ্যতের দিকে আমরা পূর্ণ আস্থার সঙ্গে তাকাতে পারি।’ খালেদা-জামায়াত জোট এই অবস্থান থেকে সরে আসেনি। স্বপ্নে, জাগরণে, ধ্যানে-জ্ঞানে তাই তারা পাকিস্তান দেখেন, পাকিস্তানের নাম জপেন।
×