ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

বুয়েটের অধ্যাপকের জবানবন্দীতে ব্যাপক গরমিল

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৬ মার্চ ২০১৫

বুয়েটের অধ্যাপকের জবানবন্দীতে ব্যাপক গরমিল

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিকেল এ্যান্ড ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী অভিজিত হত্যাকা-ের মামলার জিজ্ঞাসাবাদে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে ব্যাপক গরমিল পেয়েছে ডিবি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া জবানবন্দীতে ব্যাপক গরমিল পাওয়ার কারণে তার ওপর দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নিহত অভিজিত রায়ের বাবা ড. অধ্যাপক অজয় রায়ের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুয়েটের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে ডিবি পুলিশ মঙ্গলবার বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাতের বেলায় ছেড়ে দেন। অপরদিকে বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায় হত্যা মামলার রিমান্ড শেষে শফিউর রহমান ফারাবীকে আদালতে পাঠিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীকে ফেসবুকে কটূক্তি করার অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের দায়ের করা মামলায় বুধবার ৫ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, বুয়েটের ইলেকট্রিকেল এ্যান্ড ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে অভিজিত হত্যাকা-ের মামলার বিষয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তিনি জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে বলেছেন, বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজিতের সঙ্গে আলাপ করেছেন। তার কাছে ১০ মিনিটের মতো ছিলেন অভিজিত। তিনি বলেছেন, অভিজিতকে ফেসবুকের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তার দেয়া তথ্যের সঙ্গে অভিজিত হত্যাকা-ের সময়ে তার সঙ্গে থাকা গুরুতর আহত স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা তার শ্বশুর অধ্যাপক অজয় রায়কে যে তথ্য দিয়েছেন তার সঙ্গে ব্যাপক গরমিল পেয়েছে ডিবি পুলিশ। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক অভিজিত রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে। তারপর হাসপাতালে নেয়ার পর অভিজিতের মৃত্যু ঘটে এবং স্ত্রী বন্যা দুই দিন বাংলাদেশে চিকিৎসা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিত দম্পতি। বন্যা যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে ও পরে তার শ্বশুর অধ্যাপক অজয় রায়কে অভিজিত ও তার ওপর হামলার ঘটনার রাতের অনেক ঘটনা বর্ণনা করে তথ্য দিয়েছেন। ডিবি সূত্র জানায়, বন্যা তার শ্বশুর অজয় রায়কে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, অভিজিত ও তার স্ত্রী বন্যা অনেক আগে থেকেই চিনতেন বুয়েট অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে। ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী অভিজিতকে বই মেলায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ‘টেলিফোনে’। শুদ্ধস্বরের পরে একটি ওপেন জায়গায় বসে আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সেখানে যান অভিজিত। ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বলেছেন, বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বন্যা তার শ্বশুর অজয় রায়কে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, অভিজিতের বই নিয়ে আলোচনা হবে। অভিজিত আসতে পারবে কি না সেই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ফারসীম মান্নান। অভিজিত উত্তরে বলেছিলেন, আসতে পারবে। অভিজিত আসতে পারার সময়ে বলেছিলেন, আমি শুদ্ধস্বরের এখানে একটি প্রোগ্রাম করছি। এই প্রোগ্রাম শেষে তোমাদের (ফারসীম) ওখানে যাব। তারপর ফারসীমের কাছে যান অভিজিত ও তার স্ত্রী বন্যা। অভিজিত বই মেলায় যাওয়ার আগেই টেলিফোনে যখন কথা হয় তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ওখানে আর কে কে আসবে? ফারসীম তাকে (অভিজিত) বলেছিলেন আরিফ আসবে। আরিফও একজন ব্লগার ও আর্টিকেল লিখে এবং বক্তৃতা দেন। বন্যা যে তথ্য দিয়েছেন তাতে তাদের যাওয়ার কথা ছিল বিকেল ৫টায়। তখন তাদের (অভিজিত দম্পতি) বলা হয়েছিল, ৫টায় লোকজন আসবে না। তোমরা ৭টা, সাড়ে ৭টার দিকে আসো। অভিজিত দম্পতি সাড়ে ৭টার দিকে যান বই মেলায়। অভিজিত দম্পতি সেখানে গিয়ে দেখেন ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীসহ ওখানে বসে আছেন অপরিচিত কয়েকজন। অভিজিত দম্পতি তখন জিজ্ঞেস করেন আসিফ কই? নিত্য কোথায়? ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর উত্তর ছিল, ওরা আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা আর আসেনি। তারপর সেখান থেকে ফিরে আসেন অভিজিত দম্পতি। ফিরে এসেই খুন হন অভিজিত ও গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী বন্যা। অভিজিতের বাবা অজয় রায় সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, সম্ভবত এটা এ্যারেঞ্জইড। তবে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর ভূমিকা হয়ত বা ইনোসেন্টলি (নির্দোষভাবে) হতেও পারে। তবে তার (ফারসীম) সঙ্গে কথা বলব আমি (অজয় রায়)। তারা দু’জনে কথাও বলেছিলেন। অজয় রায়ের কথা হচ্ছে, ফারসীম ইনভলবড, তা হয়ত বা নাও হতে পারে। কিন্তু সে হয়ত বা ইনোসেন্টলি কাজটা করেছে। কিন্তু ডিবির কর্মকর্তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী অভিজিত মার্ডারের সঙ্গে ইনভলবড আছে কি নেই সেটা তদন্তে আসবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীই যে অভিজিত দম্পতিসহ আরও যাদের সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, এটা দিবালোকের মতো সত্যি। তিনি কাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তা তিনিই জানেন। আর আসিফ ও নিত্যসহ অন্যরা আসলেন না কেন? অনাহুত অপরিচিত যারা উপস্থিত ছিলেন তারা কারা? এটার উত্তর একমাত্র জানা ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীরই। এমনকি বন্যা যে তথ্য দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, অনাহুত অপরিচিতরা অভিজিতকে সম্বোধন করেছিলেন ‘দা’। তাহলে তাদের (অপরিচিত) কেউ চিনিয়ে দিয়েছেন অভিজিতকে। শুধু তাই নয়, অভিজিতকে তারা (অপরিচিতি) বলেছেন, অভিজিত দা চলেন, আমরা চা খাই। তারপরের ঘটনা হচ্ছে, এ সময় ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ঘটনাস্থল (বইমেলা) থেকে চলে গেছেন। তারপর অভিজিত দম্পতিও চলে আসেন। তারপরই খুনের ঘটনা। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, আসিফের সঙ্গে বন্যাদের কথা হয়েছে অনেক পরে। তখন বন্যাকে ও (আসিফ) বলেছে যে, আমাকে তো বলেনি। আসিফকে বলেনি, নিত্যকেও বলেনি। ফারসীম বলেছিলেন, আসিফ আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু ওরা যখন যায়, তখন আসিফ-নিত্য কেউ ছিল না। আসিফ পরে বলেছে যে, ‘আমাকে তো নিমন্ত্রণও করা হয়নি’। এটা ওদের মারা-টারার পরে যখন আসিফকে বন্যা টেলিফোনে জিজ্ঞাস করেছিল। অভিজিত খুন হওয়ার পর, আসিফ ও নিত্যকে টেলিফোন করে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাদের সেখানে আমন্ত্রণে গেলেন না কেন? আসিফ ও নিত্যর জবাব ছিল, তাদের তো আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। তাহলে যে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বলেছেন, আসিফ আসবে, নিত্য আসবে। আর অভিজিত যে সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আসিফ কই? নিত্য কোথায়? এসব প্রশ্নেরও উত্তরের মধ্যে নিহিত থাকতে পারে অভিজিত হত্যাকা-ের রহস্যের জট। অভিজিতকে হত্যার হুমকিদাতা ফারাবীকে গত ২ মার্চ যাত্রাবাড়ী থেকে আটক করে র‌্যাব। পরে র‌্যাব তাকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হন্তান্তর করে। গোয়েন্দা পুলিশ অভিজিত হত্যাকা-ে দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় এবং ১০ দিনের রিমান্ডে আনে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে রমনা থানার মামলাটি গত ১৪ মার্চ দায়ের করেন ডিবির পরিদর্শক ফজলুর রহমান। মামলাটিতে তসলিমা নাসরিনের লেখা বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সম্পাদক নঈম নিজামকেসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ করা হয় ফারাবীর বিরুদ্ধে। এছাড়া ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে শেরে বাংলানগর থানায় গত বছর দায়ের করা হয়েছিল আরও একটি মামলা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে অভিজিত রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা অভিজিত রায়কে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত বন্যাকে পরে যুক্তরাষ্ট্রে নেয়া হয়। ছেলে অভিজিত হত্যাকা-ের ঘটনায় বাবা শিক্ষাবিদ একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. অধ্যাপক অজয় রায় পরের দিন শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতসংখ্যক আসামি করে মামলা করেন।
×