ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবাসন খাতে পাঁচ থেকে ১০ বছরের জন্য কালো টাকা চায় রিহ্যাব

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৫ মার্চ ২০১৫

আবাসন খাতে পাঁচ থেকে ১০ বছরের জন্য কালো টাকা চায় রিহ্যাব

রহিম শেখ ॥ দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফ্ল্যাট বিক্রি কমে গেছে ৬০ শতাংশ। নতুন ভবন নির্মাণও কমেছে ৭৫ শতাংশ। প্রবাসীরাও বিমুখ ফ্ল্যাট কেনায়। একদিকে খেলাপী হওয়ার শঙ্কা ও অন্যদিকে ব্যাংকগুলো আবাসন ব্যবসায়ীদের ঋণ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য খাতেও মন্দা নেমে এসেছে। এই মন্দাবস্থা কাটাতে আবারও অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ চায় রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। এবার পাঁচ থেকে ১০ বছরের জন্য এ সুযোগ চায় সংগঠনটি। যদিও চলতি অর্থবছরে আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য এ সুযোগ থাকলেও এতে তেমন সাড়া নেই। আসন্ন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকাসহ আবাসন খাত রক্ষায় নিবন্ধন ব্যয় ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছে রিহ্যাব। সংগঠনটি বলছে, চলতি ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলেও টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে এ অর্থের তেমন বিনিয়োগ হয়নি। ফলে সুফল পাননি আবাসন ব্যবসায়ীরা। এখনও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফ্ল্যাট বিক্রি কমে গেছে ৬০ শতাংশ। নতুন ভবন নির্মাণও কমেছে ৭৫ শতাংশ। প্রবাসীরাও ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। খেলাপী হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। ব্যাংকগুলো আবাসন ব্যবসায়ীদের ঋণ কমিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় এ খাত রক্ষা করতে আবারও এই সুযোগ দেয়ার বিকল্প নেই বলে সংগঠনটি মনে করে। সরকার কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিলেও তাতে খুব একটা লাভ না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এক বছরের জন্য এই সুযোগ দিলে তাতে ফল আসে না। সে কারণে আমরা পাঁচ বছরের জন্য এ সুযোগ চেয়েছি। তাহলে মানুষের ভয়টা কেটে যাবে। এ খাতে তারা তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। নইলে তাদের এই টাকাটা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৯বিবিবিবিবি ধারা রয়েছে। গত দুটি অর্থবছরে বাজেটে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে আয়ের বিপরীতে যে পরিমাণ কর এত দিন দেয়া হয়নি, তা দেয়া এবং এর সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দেয়ার বিধান চালু করা হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আবাসন খাতে প্রতি বর্গমিটারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদান করলে বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগ মেনে নেয়ার বিধানটি কর প্রদান পদ্ধতিতে সরলীকরণমাত্র। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটেও আবাসন খাতে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান ছিল। স্থবির আবাসন খাতে গতিশীলতা আনার কথা বলে সেই সুযোগ দেয়া হয়। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল এবং দিলকুশা এলাকায় অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে জমি-বাড়ি কিনলে ২০০ বর্গমিটার পর্যন্ত (তিন কাঠা) প্রতি বর্গমিটারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা কর দিতে হয়। তিন কাঠার বেশি জমি বা ফ্ল্যাট কেনা বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবর্গমিটারে ৭ হাজার টাকা কর দিতে হয়। ঢাকার ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তিন কাঠা জমি-বাড়ি কিনতে হলে প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৪ হাজার টাকা কর দিতে হয়। আর তিন কাঠার বেশি কিনলে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা করে কর। জানা গেছে, অপ্রদর্শিত আয়কে বিনিয়োগে ব্যবহার করার জন্য এ দেশে বহুবার নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কখনও তেমন ফল পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। এমনকি আয়কর অধ্যাদেশে স্থায়ীভাবে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে কালো টাকা সাদা করার আইনী সুযোগ রাখা হয়। এই ধারাটি হচ্ছে ১৯ই। এর ফলে প্রযোজ্য আয়করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিলে যে কেউ অর্থ সাদা করতে পারবেন। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গাড়ি, জমি ও ফ্ল্যাট কিনে কালো টাকা সাদা করা-সংক্রান্ত আয়কর অধ্যাদেশের সব ধারা (১৯বি, ১৯বিবি, ১৯বিবিবি) বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। বর্তমান সরকার আবার গাড়ি ছাড়া বাকি সব সুযোগ নতুন করে দিয়েছে। তবে গত দুই বছরে আবাসন খাতে কালো টাকার ঠিক কত বিনিয়োগ হয়েছে তার কোন তথ্য নেই রিহ্যাবের কাছে। রিহ্যাব বলছে, তেমন একটা বিনিয়োগ হয়নি। হলেও খুবই সামান্য। সূত্র মতে, বর্তমানে শুধু জেলা শহরে নগরায়নের জন্য কর অবকাশ ব্যবস্থা প্রযোজ্য আছে। কিন্তু জেলা শহরগুলোতে ফ্ল্যাটের চাহিদা সৃষ্টি না হওয়ায় এই উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে না। সে কারণে বিভিন্ন মেট্রোপলিটন এলাকা, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, পৌরসভার বাইরের এলাকায় নগরায়নকে উৎসাহিত করতে কর অবকাশ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার পক্ষে রিহ্যাব। রিহ্যাব বলছে, সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় দেশে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) ব্যয় অনেক বেশি। সে কারণে অনেক ক্রেতা নিবন্ধনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আর সরকারও এই খাত থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে। এ কারণেই নিবন্ধন ব্যয় কমানোর পক্ষে মতামত তুলে ধরে সংগঠনটি বলছে, চলতি অর্থবছরে ফ্ল্যাট ও প্লট রেজিস্ট্রেশনে মোট খরচ পড়ে ক্রয়মূল্যের ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে গেইন ট্যাক্স ৪ শতাংশ, স্ট্যাম্প ফি ৩ শতাংশ, রেজিস্ট্রেশন ফি ২ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ২ শতাংশ ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ৩ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে সব ক্ষেত্রেই কর ও ফি অর্ধেক করে রেজিস্ট্রেশন খরচ ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে রিহ্যাব। নামমাত্র রেজিস্ট্রেশন ব্যয় নির্ধারণ করে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা (দ্বিতীয়বার বিক্রয় পদ্ধতি) প্রবর্তনের প্রস্তাব করে রিহ্যাবের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি, গেইন ট্যাক্স ইত্যাদি বিদ্যমান ব্যয় কমিয়ে মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে দ্বিতীয়বার ফ্ল্যাট বা প্লট ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। ফলে একই সম্পত্তি একাধিকবার হাতবদল হলেও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং আবাসন শিল্পে সেকেন্ডারি বাজার সৃষ্টি হবে। আবাসন খাত রক্ষায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় ২০ হাজার কোটি টাকার ‘হাউজিং লোন’ নামে একটি তহবিল গঠন করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব করেছে রিহ্যাব। সংগঠনটির সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বমন্দা, জমির উচ্চমূল্য, শেয়ারবাজার ধস ও নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় এ খাতে দীর্ঘদিন ধরে স্থবিরতা চলছে। রিহ্যাব উইন্টার ফেয়ার আয়োজনের পর এই নাজুক অবস্থা কিছুটা কাটার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ফ্ল্যাট কেনার জন্য পর্যাপ্ত ঋণ মেলেনি। এরই মধ্যে জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে এ খাতে ফের স্থবিরতা নেমে আসে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশের গৃহায়ন শিল্পের মারাত্মক ও অপূরণীয় ক্ষতি হবে। তাই নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে।
×