ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষ সাক্ষাতকারে কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. হেলেন জারভিস

গণহত্যা বিচারে প্রমাণ সংগ্রহে কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ মার্চ ২০১৫

গণহত্যা বিচারে প্রমাণ সংগ্রহে কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে

তৌহিদুর রহমান ॥ কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. হেলেন জারভিস বলেছেন, গণহত্যার বিচারের জন্য আলামত ও প্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে অগ্রগতি বেশি। এছাড়া বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বে প্রথমবারের মতো সুপরিকল্পিতভাবে নারী ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর ১৯৭১ সালের নারী ধর্ষণের চিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুবই অল্প উঠে এসেছে। বাংলাদেশে গণহত্যার পাশাপাশি নারী ধর্ষণের বিচারকেও অনেক গুরুত্ব দিতে হবে। গণহত্যার বিচারে বিলম্বের অজুহাত তুলে এখন বিচার করা যাবে নাÑ এমন যুক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘বাংলাদেশের গণহত্যা ও ন্যায়বিচার’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে সম্প্রতি ঢাকায় আসেন ড. হেলেন জারভিস। ঢাকায় অবস্থানকালে জনকণ্ঠকে তিনি এ বিশেষ সাক্ষাতকার দেন। কম্বোডিয়ার গণহত্যার বিচারের গঠিত এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বারস্ ইন দ্যা কোর্ট অব কম্বোডিয়ার (ইসিসিসি) তথ্য বিভাগের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা ড. হেলেন জারভিস বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। তবে ঘটনার দীর্ঘদিন পরে এ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করাটা সত্যিই কঠিন একটি কাজ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা এখন সঠিকভাবে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার গণহত্যার বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে তুলনামূলক মন্তব্য জানতে চাইলে হেলেন জারভিস বলেন, বাংলাদেশের মতো কম্বোডিয়ার জনগণকেও অনেক দিন ধরে গণহত্যার বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। কম্বোডিয়ায় প্রায় ৩০ বছর অপেক্ষার পরে বিচার কাজ শুরু হয়। সেখানেও এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু ছিল অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তবে গণহত্যা যেখানেই হোক না কেন, তার বিচার হতে হবে। আর এখন সেটা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ায় বিচার প্রক্রিয়া বিলম্ব মানে এমন নয় যে, বিচারকাজ শুরু করা যাবে না। এটা কোনভাবেই অজুহাত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিচার কাজের জন্য আলামত ও প্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে অগ্রগতি বেশি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তরা অনেকদিন বিচারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে এখন বিচার চলছে। এটা সত্যিই খুব ভাল উদ্যোগ। বাংলাদেশের গণহত্যার বিচারের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছেÑ এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে হেলেন বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ সক্রিয়। তারা এ বিচারের বিরুদ্ধে এখানে কোথাও কোথাও সহিংসতা চালিয়েছে। এ সহিংসতা বাংলাদেশ সরকার মোকাবেলাও করেছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে নারী নির্যাতনের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কম্বোডিয়ার গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ড. হেলেন জারভিস বলেন, বিশ্বে প্রথমবারের মতো সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে কারণেই দুই লাখেরও বেশি নারী এখানে ধর্ষণের শিকার হন। আর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও সে সময় খুবই অল্প পরিসরে বিষয়টি তুলে ধরেছিল। এখনও এ বিষয়ে গবেষণা ও কাজের সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের উত্তরে জারভিস বলেন, ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়ন করেছিলেন, সেখানে শুধু গণহত্যার বিষয়টিই যুক্ত ছিল না, নারী ধর্ষণের বিষয়টিও সমানভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। তাই গণহত্যার বিচারের পাশাপাশি এখন নারী ধর্ষণের বিষয়গুলোকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নারী ধর্ষণের জন্যও দোষীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। যুদ্ধে নারী ধর্ষণের বিচারের বিষয়ে কোন দেশে বিশেষ অগ্রগতি রয়েছে কি-না জানতে চাইলে হেলেন জারভিস বলেন, যুদ্ধ অথবা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে নারী ধর্ষণ করার ঘটনা বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এটি ভয়াবহভাবে ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এরপর বসনিয়ায় ভয়াবহ নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। রুয়ান্ডাতেও নারী ধর্ষণ ছিল ভয়াবহ। তবে ১৯৯৮ সালে রুয়ান্ডাতেই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ধর্ষণকে মানবাতবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা সেই হিসেবে বিচার শুরু হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়ায় খেমারুজ শাসনমালে সংগঠিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার চলছে। সেখানে ইতোমধ্যেই যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত কম্বোডিয়ার সাবেক নেতা খিউ সাম্পান ও নুওন চিয়ার বিরুদ্ধে এখন গণহত্যা মামলার বিচার শুরু করেছে জাতিসংঘ সমর্থিত কম্বোডিয়ান ট্রাইব্যুনাল। গত অক্টোবর মাস থেকে সাবেক দুই খেমাররুজ নেতার গণহত্যার মামলার বিচার শুরু হয়েছে। খেমাররুজ শাসনামলে তারা ভিয়েতনামের জনগণ ও জাতিগত মুসলিমদের ওপর গণহত্যা, জোরপূর্বক বিয়ে ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। খেমারুজ সরকার পতনের পর থেকেই ড. হেলেন জারভিস কম্বোডিয়ার গণহত্যার বিষয়ে কাজ করছেন।
×