ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রক্তাক্ত ২৫ মার্চ

বাঙালী নিধনযজ্ঞের ভয়াল কালরাত আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ মার্চ ২০১৫

বাঙালী নিধনযজ্ঞের ভয়াল কালরাত আজ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ “অবিনাশী আগুনে পোড়ে হায়রে শোকার্ত স্বদেশ/ দুখিনী মায়ের অশ্রু জমা হয় নিভৃত পাঁজরে/ যে যাবে যুদ্ধে এখনই সে উঠুক উঠুক ঝলসে/ যে যাবে যুদ্ধে সবকিছু ভাঙুক সে....।” ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কৃষ্ণপক্ষের রাত। এ রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যা। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আগুনের শিখা আকাশকে বিদ্ধ করেছিল। এক সময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধূম্রকু-লী ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লকলকে শিখা। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈতী হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। দিন শেষে এলো সেই ভয়াল রাত। তখনও কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় কালরাত আসছে বাঙালীর জীবনে। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে তখন ঘুমিয়েও পড়েছে। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। অকস্মাত যেন খুলে গেল নরকের সব দরজা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এ নামে মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক নামল ঢাকার রাস্তায়। রাস্তের স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক। আজ সেই ভয়াল, বীভৎস ২৫ মার্চ। বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রীর নাম ২৫ মার্চ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনে বাঙালী জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা। গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানী দানবরা মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালী নিধনযজ্ঞে। এ রাতেই বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে ভয়ঙ্কর মাত্র এক রাতেই হানাদাররা হত্যা করেছিল হাজার হাজার ঘুমন্ত বাঙালীকে। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন- “সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে। ঢাকায় ঘটনা শুরু মাত্র হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।” ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের ভূখ-ে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর কায়দায় রাতের অন্ধকারে পাকি জল্লাদ বাহিনী এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তা-ব। হকচকিত বাঙালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাথ, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই মৃত্যু রেখে গেছে তার করাল স্বাক্ষর। মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে এলো শহরের আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুর্মুহু আগুনের লেলিহান শিখা। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। একাত্তরের এ দিনে চির আকাক্সিক্ষত ও প্রিয় স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল লাখো বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার সোঁদা মাটি। ঘুমন্ত শিশু, বধূ, বৃদ্ধার রক্তে কলঙ্কিত হলো মানব ইতিহাস। সেই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান- হালাকু খানদের নৃশংস নির্মমতাকেও হার মানায়। এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার ন’মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক-দালাল, রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র ন’মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই। স্তম্ভিত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বর্বর পাকসেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস্য হত্যাকা-ই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পাননি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) সামনের সাকুরার পেছনের গলিতে থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এরপর একে একে দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও। কী ঘটেছিল সর্বনাশা সেই ভয়াল রাতে ॥ সূর্য ডুবল। পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট বিমান করে করাচী পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালী হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদেপোড়া নগরী চৈত্রের হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। তারপর দু’ঘণ্টাও যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই দিয়ে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছে। গোলন্দাজ, সাঁজোয়া পদাতিক ও নৌ তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে পাকি ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তা-ব। প্রতিটি রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ হিন্দুছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্ত শকুনিরা শুধু হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। পাক জান্তারা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ মাটি চাপা দিয়েছিল পাক সেনারা। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে শকুনির দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল। পাক জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদারেরা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে। চারদিকে কেবল প্রজ্বলিত অগ্নিকা-, ধ্বংস আর মর্মন্তুদ চিৎকার। মধ্যরাতেই ঢাকা তখন লাশের শহর। দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও একইভাবে অতর্কিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক সেনারা। অবশ্য এই পরিস্থিতিতেও বাঙালী ছাত্র-জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ঢাকার ফার্মগেট থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় এলাকার চারপাশে সর্বত্র এই প্রতিরোধ ছিল। প্রতিরোধ ছিল চট্টগ্রামেও। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে সেদিন কিছুই করতে পারেননি অকুতোভয় বাঙালী। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ॥ ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে শুভাকাক্সক্ষীরা তাঁর বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ করেন। তাঁর জন্য হেলিকপ্টারও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানী বাহিনী তাঁকে না পেলে একজন বাঙালীকেও বাঁচতে দেবে না। সে রাতে তাঁকে না পেলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়া হতো পুরো শহর। ওই দিন জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বললেন, ‘মুজিব দেশের অখ-তা ও নিরাপত্তার ওপর আঘাত হেনেছেন। এ অপরাধের জন্য তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে। দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আজ আমি দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এরপর গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে করাচীর পথে ঢাকা ত্যাগ করেন জল্লাদ ইয়াহিয়া। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো।’ রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালীর মতোই নিজেরই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত একটা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’ ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। এদিকে চট্টগ্রামে তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ষোলশহর এলাকায় গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ ব্যুহ। সারাদেশেই যখন বাঙালীর প্রতিরোধের আগুন, তখন ২৫ মার্চ রাত এগারোটার দিকে বাঙালীর মধ্যে চট্টগ্রামে কর্মরত সিনিয়র অফিসার মেজর জিয়া তাঁর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে ‘এমভি সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে রওনা হন। পথে অনেক স্থানের বাঙালীর দেয়া ব্যারিকেড সরিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে রাত নয়টার দিকেই পাক হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনানিবাসে বাঙালীদের ওপর। নির্বিচারে হত্যা করা হয় সহস্রাধিক বাঙালী সেনা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যকে। ক্যাপ্টেন রফিকের প্রতিরোধের সংবাদ এবং সেনানিবাসে হামলার ঘটনা শুনে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান যখন মেজর জিয়ার সঙ্গে রাস্তায় ব্যারিকেড সরানো অবস্থায় দেখে ঘটনা খুলে বলেন, তখন মেজর জিয়া তাঁদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে তিনি তাঁর নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেজর জিয়া যখন রাত একটার দিকে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন শমসের মবিনসহ অন্যদের মাঝে ফিরে আসেন ততক্ষণে পাক সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধও ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। এদিকে গাজীপুরেও শফিউল্লাহর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় তীব্র প্রতিরোধ। এরপর আর বীর বাঙালীকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক সাগর রক্তের ঢেউ পেরিয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ ও আকাক্সক্ষার ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, সোনার বাংলা। কর্মসূচী ॥ জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার বীর বাঙালীদের। রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক সংগঠন ‘কালরাত্রি’ স্মরণে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। দিনভর থাকছে আলোচনা সভা, শোকসভা ও রাতে মোমবাতি প্রজ্বলন। শোকাবহ জাতি কালরাত্রিতে ঘৃণা ও ধিক্কার জানাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও তাদের মদদদাতাদের। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ভয়াল সেই কালরাত্রি স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল বের করবে। শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিলটি জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে শেষ হবে। রাত আটটায় আলোর মিছিলপূর্ব শহীদ স্মরণে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। আলোচনা শেষে স্বাধীনতা ও গণহত্যার ৪৪তম বার্ষিকীতে আজ ৪৪ মশাল প্রজ্বলন ও আলোর মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের প্রামাণ্য ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হবে। বিকেল সাড়ে চারটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
×