ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

নৈরাজ্য ও হত্যা প্রতিরোধ করা

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৫ মার্চ ২০১৫

নৈরাজ্য ও হত্যা প্রতিরোধ করা

আমরা নানা সমস্যার মধ্যে জীবনযাপন করেও গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, অন্যদিকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে অথেনটিক কোয়ালিটি তৈরি করতে পারছে না। যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু থেকে থেকে সামরিক ক্যু হওয়ার দরুন আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌম হয়নি ও গণতন্ত্র আমাদের অধিকার সর্বজনীন করেনি। এই বৈপরীত্যের দরুন গণতন্ত্র বহুবাদী রাজনৈতিক ডকট্রিনে পর্যবসিত হয়নি। অন্যদিকে সামরিক টিরেনি গণতন্ত্রের রাজনৈতিক ডকট্রিনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের সিস্টেম তৈরি করেছে। আমাদের রাজনীতি: ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং সমাজ জীবন সম্বন্ধে কোন ঔৎসুক্য তৈরি করেনি : রাজনীতির মধ্যে মানুষী অস্তিত্ব ও আচরণের প্রকাশ ঘটেনি। আমরা অভিজ্ঞতাশ্রয়ী ও যুক্তিবিশ্বাসী ব্যক্তি ও সমষ্টিতে পরিণত হয়নি। টিরেনি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা বেড়েছে, কিন্তু লিবার্টি সম্বন্ধে ধারণা বাড়েনি। আমাদের কাছে দেশটা ও রাষ্ট্রটা আধুনিক পৃথিবীর অংশ হিসেবে দেখা দিয়েছে তিন দিক থেকে। প্রথম দিক হচ্ছে পপুলিজম, যার অর্থ হচ্ছে এই বিশ্বাস যে, মানুষ নিজেদের একটা সংস্কৃতির সভ্য হিসেবে বুঝতে ও বোঝাতে সক্ষম, যখন তার শিকড় ভাষা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের মধ্যে প্রোথিত থাকে। দ্বিতীয় দিক। এক্সপ্রেশনিজম, যার ধারণা হচ্ছে যখন মানুষ বিভিন্ন ব্যক্তির কণ্ঠে নিজেদের প্রকাশ করতে সক্ষম হয়, যে-প্রকাশে জীবনের একটি সমগ্র ভিশন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তৃতীয় দিক হচ্ছে : প্লøুরালিজম, তার অর্থ হচ্ছে : সংস্কৃতির অনিঃশেষ বৈচিত্র্য ও মূল্যবোধের বিভিন্নতা, চূড়ান্তে সমতাসম্পন্ন। আমরা যে রাজনীতি তৈরি করেছি, সেখানে পপুলিজম, এক্সপ্রেশনিজম এবং প্লুরালিজম কার্যকর নয়, সেখানে তাদের কোন জায়গা নেই। জায়গাটা না-থাকাটা ভয়ের, অথচ মানুষ হিসেবে আমরা নিরাপদ খুঁজি। আইসায়া বের্লিন এই পরিস্থিতির একটি ডকট্রিন তৈরি করেছেন, যে ডকট্রিন একই সঙ্গে গভীর ও মৌলিক। ব্যক্তিক লিবার্টির যে গৎবাঁধা লিবারেল যুক্তি আছে, যে যুক্তি আমাদের রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মুখে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না। বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোগুলো তার প্রমাণ। সে ক্ষেত্রে বের্লিন নেগেটিভ লিবার্টির ওপর জোর দিয়েছেন। নেগেটিভ লিবার্টি হচ্ছে বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া জীবনযাপন করার ফ্রিডম। আমাদের রাজনীতিতে ফ্রিডম হচ্ছে হস্তক্ষেপ করার অধিকার, যে-অধিকার ধর্মমনস্ক রাজনৈতিক দলগুলো হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি চূড়ান্তে নিয়ে গেছে। ধর্মে বিশ্বাস কিংবা ধর্মজ রাজনীতিতে বিশ্বাস ব্যক্তির ফ্রিডম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি এই দায়িত্ব নিয়ে মানুষকে উ™£ান্ত করা শুরু করেছে। সেজন্য ধর্মান্ধ রাজনীতি-উত্থিত বিশ্বাস মানুষকে নোংরা করে তুলেছে। বিভিন্ন ধর্মের সংঘাতের মধ্যে জীবনযাপন কিংবা বিভিন্ন বিশ্বাসের মধ্যে জীবনযাপন এবং বিভিন্ন বিশ্বাসের ফ্রিডম এক নয়। জীবনে বহুবিধ প্রশ্ন আছে। ধর্মের দিক থেকে সঠিক জবাব একটাই : বাদ-বাকি ভুল। সত্য জবাব আবিষ্কারের একটাই ধর্মের দিক থেকে নির্ভরশীল পথ, যে পথ থেকে সরে যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মে বিশ্বাস কিংবা ধর্মজ রাজনীতিতে বিশ্বাস ব্যক্তির ফ্রিডম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি এই দায়িত্ব নিয়ে মানুষকে উ™£ান্ত করা শুরু করেছে। সেজন্য ধর্মান্ধ রাজনীতি-উত্থিত বিশ্বাস মানুষকে নোংরা করে তুলেছে, যুক্তিবর্জিত করেছে, অন্ধ করেছে, সেই সঙ্গে বিরাট বিশ্ব সম্বন্ধে ধারণা : হিন্দু ভারত কিংবা নাস্তিক পশ্চিম কিংবা সমাজতান্ত্রিক চীন সম্বন্ধে বিদ্বেষ এবং বৈরিতার জন্ম দিয়েছে। ধর্ম কিংবা ধর্মজ রাজনীতি এক ধরনের অটোক্রেসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং বিরাট বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কেবলই হেরে যাচ্ছে। অটোক্রেসির সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং একই সঙ্গে বিরাট বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার দরুন জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে (অর্থাৎ নারীদের নিয়ন্ত্রণ করা, পুরুষ ও নারীদের বিশেষ ধরনের লেখাপড়ার ওপর জোর দেয়া, বিশেষ ধরনের পোশাক পরিচ্ছেদ ব্যবহার করা)। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে যেমন ব্যক্তিক লিবার্টি থাকে না, তেমনি গণতান্ত্রিক শাসন থাকে না। অভিজ্ঞতার একটি ক্ষেত্রকে জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে অন্ধভাবে ব্যবহার ও প্রয়োগ। ফ্রিডমের পরিসর বাড়ছে না। রাজনীতি ভাবনার ইতিহাসের একটি অংশ : এই বোধ আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির মডেল থেকে মানুষের জীবনযাপনের কোন স্থিতিশীল ভিশন তৈরি হচ্ছে না। জন রাউলসের চিন্তার সূত্র ধরে বলতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রক্ষেত্রে সমতাসম্পন্ন লিবার্টির অধিকারী নাগরিক থাকে না। নাগরিকদের মৌল লিবার্টি হচ্ছে : রাজনৈতিক লিবার্টি। তার সঙ্গে যুক্ত কথা বলার ও সভা-সমিতি করার অধিকার, বিবেকের অধিকার ও চিন্তার স্বাধীনতা। আইনের শাসনের কনসেপ্ট যেভাবে সংবিধানে বর্ণিত সেই মোতাবেক জবরদস্তি এ্যারেস্ট থেকে ফ্রিডম লাভ করা। তাহলেই জাস্ট অধিকারসম্পন্ন নাগরিকদের শাসন সম্ভব। তাহলেই রাজনীতির নৈরাজ্য নিরোধ করা সম্ভব, যদি আমরা নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং হত্যার বিরুদ্ধে যেতে চাই।
×