ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিজিত হত্যা তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই

সন্দেহভাজন তালিকার ১০ জনের কাউকেই গ্রেফতার করা যায়নি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৩ মার্চ ২০১৫

সন্দেহভাজন তালিকার ১০ জনের কাউকেই গ্রেফতার করা যায়নি

শংকর কুমার দে ॥ বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিত রায় হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্তের অবস্থা অনেকটা ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’। হত্যাকা-ের আগে ফেসবুকে হত্যার হুমকিদাতা ১০ জনের কাউকেই গ্রেফতার করা যায়নি এখনও। প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও হত্যকা-ের ঘটনা রহস্যের জালে আটকা পড়ে আছে। পুলিশের নাকের ডগায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটার সময় তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকার কারণে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর তদন্তে সহায়তার বিষয়টিও দৃশ্যমান হয়নি। ছেলে অভিজিত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত কোন হত্যাকারী ধরা না পড়ায় বাবা ড. অধ্যাপক অজয় রায় অসন্তুষ্ট। হত্যাকাণ্ডের তদন্তে মারাত্মক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসব্যাপী হত্যাকা-ের এতসব ঘটনা কেবলই বাগাড়ম্বরে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকগণ। তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অভিজিত হত্যাকা-ের তদন্ত প্রথম অবস্থায় যেই তিমিরে ছিল এখনও সেই তিমিরেই। কতজন হত্যাকা-ে অংশ নিয়েছে, হত্যাকারী কারা, তাদের নাম-পরিচয় কি, হত্যাকাণ্ডের পর পালাল কিভাবে, হত্যাকারীরা ধরা পড়ছে না কেন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর ডিবি পুলিশের এখনও অজানা। হত্যাকাণ্ডের সময়ে সেখানে ছিল অসংখ্য মানুষ। অদূরেই কর্তব্যরত অবস্থায় ছিল পুলিশের টিম। অভিজিত হত্যাকা-ের সময়ে পুলিশ সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের ঘটনায় গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মীর রেজাউল আলমের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনও পায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে অজ্ঞাত রয়ে গেছে সেখানে কত পুলিশ ছিল, কর্তব্যরত অবস্থায় তাদের ভূমিকা কি ছিল, তার হত্যাকা-ের সময় সাহায্যের হাত বাড়ালেন না কেন ইত্যাদি ঘটনারও কোন সুরাহা হয়নি। এতে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে অভিজিত হত্যাকা- ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা আহত হওয়ার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় হিযবুত তাহরীর নেতা শাফিউর রহমান ফারাবীকে। তাকে দুই দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে অভিজিতকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছে অন্তত ১০ জন। অভিজিত রায় হত্যার সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুুলিশ (ডিবি)। হত্যাকা-ের তালিকায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া প্রধান আসামি শাফিউর রহমান ফারাবীকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু সবই অন্তসার শূন্য। বাবা অজয় রায় ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমকে বলেছেন, হত্যাকা-টি পুরোপুরি পরিকল্পিত। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এক শিক্ষকের নাম জানাবেন তিনি যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ক্লু বের হতে সাহায্য করতে পারে। হত্যাকারীরাই ডেকে নিয়ে চা খাওয়ার নাম করে তার ছেলেকে হত্যা করেছে। অজয় রায় বলেন, যে দুজন লেখকের কথা বলে সেখানে অভিজিতকে ডাকা হয়েছিল তারা তাকে জানিয়েছেন, তারা আসলে ওই বৈঠকের কথা জানতেনই না। আর এসব কারণেই বুয়েটের ওই শিক্ষকের ওপর ড. অজয় রায়ের সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। ফেসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থারত অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বলেছেন, ‘যখন অভিজিত ও আমার ওপর নৃশংসভাবে হামলা হচ্ছিল তখন পুলিশ কাছেই ছিল এবং তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি ’Ñ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামও পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশের নাকের ডগায় অভিজিত হত্যাকা- মেনে নেয়া যায় না মন্তব্য করেছেন। দায়িত্বে গাফিলতির জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে জার্নি নামে একটি বেসরকারী সংগঠনের উদ্যোগে ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা’ শীর্ষক অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা; যেখানে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকও। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি দিতে না পারার ফল মুক্তমনা লেখক অভিজিতকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক এই উপদেষ্টা। ক্লুলেস এখনও ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ও মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম রবিবার নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, অভিজিত হত্যাকা-ের সময়ে অনেক মানুষ ছিল সেখানে, তারপরও কেউ বলতে পারছে না হত্যাকাণ্ডে কতজন অংশ নিয়েছে, তারা দেখতে কেমন, কেউই পুলিশকে জানায়নি। অনেক সময় কোন জায়গায় কোন ঘটনা ঘটলে সেই ছবি তুলে রাখে স্থানীয়রা। এখানেও হয়ত বা কেউ ছবি তুলে রাখতে পারে। কিন্তু তা এখনও পুলিশের হাতে পৌঁছেনি। এই রকম কোন ছবি কেউ পুলিশকে দিলে তদন্তে সহায়তা হতো। বাংলাদেশে অনেক ক্লুলেস ঘটনাই সফলভাবে তদন্ত করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডের এখনও কিছু না পেলেও আশাবাদী বলে জানান ডিএমপির মুখপাত্র পুলিশ কর্মকর্তা। ডিএমপির মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে অভিজিত হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহযোগিতা করছে সে দেশের তদন্ত সংস্থা এফবিআই। তারা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের তদন্তে সন্তুষ্ট বলে দাবি ডিএমপি মুখাপাত্রের। হত্যাকাণ্ডের দিন বইমেলায় বিজ্ঞান লেখক ও বুয়েটের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর ডাকা একটি বৈঠক নিয়ে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের সন্দেহের কথা জানানোর প্রসঙ্গে ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল বলেন, বিষয়টি নজরে এসেছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। দরকার হলে সেই শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদও করা হবে।
×