ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এরা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে;###;ছাত্রদল-শিবিরের রাজনীতি করা এসব কর্মকর্তা উন্নয়ন কাজে পদে পদে বাধা দিচ্ছে;###;এরা এখন নব্য সরকারপন্থী বনে গেছে

প্রশাসনে ঘাপটি মারা কিছু কর্মকর্তার দৌরাত্ম্য ॥ সর্ষের মধ্যেই ভূত!

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৩ মার্চ ২০১৫

প্রশাসনে ঘাপটি মারা কিছু কর্মকর্তার দৌরাত্ম্য ॥ সর্ষের মধ্যেই ভূত!

তপন বিশ্বাস ॥ কিছু কর্মকর্তার অসহযোগিতায় সরকার কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারছে না। ঘাপটি মেরে থাকা অনেক কর্মকর্তা নিজেকে আওয়ামী আস্থাভাজন পরিচয় দিয়ে দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে এরা প্রশাসনকে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের অতি জনগুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকা-ে কোন অর্থ প্রয়োজন নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রণালয়টির সচিব নিজে। উন্নয়ন সংক্রান্ত তহবিল চেয়ে অর্থমন্ত্রণালয় পাঠানোর উদ্দেশে প্রস্তাবের ফাইলটি সচিবের কাছে গেলে তিনি নোটে লেখেন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে নেয়া প্রকল্পের অধিকাংশ টাকা আত্মসাত করা হয়। তাই এ টাকা অত্র মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দের কোন প্রয়োজন নেই। এতে মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অপর এক মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে দিতে সরকারবিরোধী আমলারা বাঁধ সেধেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদানের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা উল্লেখ করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সকল প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার পর নিয়োগে দেয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিএনপিপন্থী ওই আমলারা তাদের সহযোগীকে দিয়ে আদালতে মামলা করে তা আটকে দিয়েছেন। কয়েক মাস পর আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আবার নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যথাযথ কোটা অনুসরণ করতে হবে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রণালয়ে শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত বড় ধরনের পদোন্নতি দেয়া হয়। পদোন্নতির পর তাদের পদায়নে ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করা হয়। এর ফলে প্রগতিশীল শিক্ষকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঢাকার বাইরে পদায়ন করা হয়। অথচ ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের শিক্ষা অধিদফতরসহ ঢাকার প্রধান প্রধান কলেজে পদায়ন করা হয়। এ পরিস্থিতি নিরসনে করতে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমলাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে কেউ যদি নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারে, তাহলে তাদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে সুযোগ দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর ৭০ শতাংশ উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু পরে এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করা হয়। সিদ্ধান্তটি উল্টিয়ে পরিপত্র জারি করা হয় যে, বিদ্যালয়ে ৭০ শাতাংশ উপস্থিতি থাকলে তাকে নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস না করলেও চলবে। এমনকি নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ না নিলেও চলবে। এতে শিক্ষার মান আরও নিম্নগামী হবে বলে শিক্ষাবিদরা মত দিয়েছেন। অভিভাবকরাও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন। জামাত-বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে এ জাতীয় কর্মকা- ঘটিয়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-কে ব্যহত করছে। এতে সরকার কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারছেন না। অথচ এই কর্মকর্তারা সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে প্রশাসনের রাশ টেনে রাখছেন। এদের পক্ষে সরকারের আস্থাভাজন অনেক কর্তাব্যক্তিদের আশীর্বাদ রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বর্তমান আমলে প্রশাসনে মহাক্ষমতাধর বনে গেছেন। বরাবর মাঝ রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও তিনি এখন সরকারের বড় আস্থাভজন কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আদেশও তিনি পাত্তা দেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ বাস্তবায়নেও তার গড়িমসি করার নজির রয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা ঢাকা ডিসি অফিসের এক জুনিয়র কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেও তিনি তা করেননি। বরং ওই কর্মকর্তাকে দিয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা জমির একজনের টাকা অন্যকে দিয়ে উত্তোলন করার সুযোগ করে দেন। এতে উৎকোচ হিসেবে পাওয়া ১৫ কোটি টাকা থেকে তিনি পান ৫ কোটি টাকা বলে অভিযোগ রয়েছে। এক মহিলা কর্মকর্তাকে দিয়ে রাজধানীতে নানা প্রকার অবৈধ নামজারি করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বেয়াদবি করায় সাবেক এক সচিব ওই এসি ল্যান্ডকে প্রত্যাহারের জন্য লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু তাকে বদলি না করে আরও গুরুত্বপূর্ণ সার্কেলের এসি ল্যান্ড করা হয়। পাশাপাশি আগেরটাতেও শক্তির মাধ্যমে বহাল রাখা হয়। দুই জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে খুব দাপটের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি। ওই ডিসি অফিসের স্টাফ জনপ্রশাসনে এনে তিনি যেন মন্ত্রণালয়েই ডিসি অফিস খুলে বসেছেন। ডিসি অফিসেও তার এজেন্ট রেখেছেন এ কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তা শুধু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাই নয়, খোদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশও না মানার অসংখ্য নজির রয়েছে। সম্প্রতি শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত অতিরিক্ত সচিবকে করা হয় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এমডি। এতেও তার মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে এ জাতীয় কর্মকা-ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের অনেক কর্মকর্তা এ কর্মকর্তার নিপীড়নের শিকার বলে জানা গেছে। প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তা কিছুদিন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হওয়ার জন্য জোর তদ্বির শুরু করেন। অনেক দূর পর্যন্তও এগিয়ে যান তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। এখন তিনি নিজেকে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার করার তদ্বিরে নেমেছেন। একটি পরিচয় দেন তিনি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিলের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তাঁর সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন থাকার পর তার মুখোশ উন্মোচিত হলে তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দেয় হয় বলে জানা গেছে। এ কর্মকর্তার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। তিনি বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় এ কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ স্থানের খাস জমির একটি অংশ একটি মার্কেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি এ কাজটি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাওয়া ভবনের ক্যাডার অপর এক কর্মকর্তাও জনপ্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। এক প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে এসেই জামায়াত-বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের পক্ষে তদ্বিরে নেমে পড়েন। এক পর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক আদেশে নিজামীর একান্ত সহকারী সচিবকে (এপিএস) ঢাকার বাইরে সিলেটে বদলি করা হয়। ব্যাচমেট পরিচয় দিয়ে তিনি তা বাতিলের তদ্বির করেন। কিন্তু তার এ তদ্বির শুনতে রাজি হয়নি জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। এতে তিনি প্রচ- ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া এ কর্মকর্তা জামায়াত-বিএনপিপন্থী বিভিন্ন কর্মকর্তার পক্ষে তদ্বির করেন। জানা গেছে, জামায়াত-বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের লক্ষ্যে কৌশলে তিনি প্রতিমন্ত্রীকে ব্যবহার করেন। কোন কোন সময় প্রতিমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করেন। আবার কখনও বা প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে সুপারিশ করান। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ কর্মকর্তা জামায়াত-বিএনপির কাছে পৌঁছে দেন বলেও খবর রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ফাইল আটকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে কালক্ষেপণেরও নজির রয়েছে। বিগত ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর তারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের কর্মকর্তাদের চাকরি চ্যুতসহ নানা হয়ারানী শুরু করে। ৯৬ সালে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠনের অভিযোগে ৪৬ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে চারদলীয় জোট সরকার। এই ৪৬ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার আদেশ জারি করেন বর্তমান প্রতিমন্ত্রীর এ একান্ত সচিব এবং বর্তমানে মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদে থেকে এ দুই কর্মকর্তার জারি করা আদেশে জনতার মঞ্চে যুক্ত থাকার অভিযোগে স্বাধীনতার স্বপক্ষের ৪৬ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ সময় হাওয়া ভবনের আশীর্বাদ পুষ্ট না হলে এবং তাদের আস্থাভাজন না হলে কোন কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসনের এপিডি উইয়িং বা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হতো না। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে এ কর্মকর্তা বিদেশে পোস্টিং নিয়ে চলে যান। কিন্তু ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক আমলে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে তাকে ওএসডি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তদ্বির করে প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিবের দায়িত্ব নিয়ে কর্তৃত্বই হাতে নিয়েছেন। এ একান্ত সচিব এবং হাওয়া ভবনের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ও বর্তমান মেট্রোরেলের পিডি এখন আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন বনে গেছেন। এতে স্বাধীনতার স্বপক্ষের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে জামায়াত-বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের আধিক্য রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও খানিকটা একই রকমের। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে থেকে তারা সরকারের বিরুদ্ধে একটির পর একটি ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সরকার ভাল কাজ করেও কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারছে না।
×