ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৩ মার্চ ২০১৫

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে রেকর্ড

রহিম শেখ ॥ টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই গুণ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এত বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো আমানতে সুদহার কমানোর কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। ঝুঁকিহীন এবং বেশি মুনাফার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় সরকারের ব্যাংক ঋণের চাপ কমছে। ফলে সরকারও এ খাত থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঋণ পাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি সংক্রান্ত জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৮ হাজার ২৮৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ হাজার ২২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বেশি। এ বছর নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। চলিত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে। এই সময়ে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার ১২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৬ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে আট মাসে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ৩ হাজার ৪৬৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল্য পরিশোধ বাবদ ৮ হাজার ২৫০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ১০৮ কোটি ২ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এসেছে ২ হাজার ৫৪৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৯২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৮২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়েছে ৫৩১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল্য পরিশোধ বাবদ ১০৪৪ কোটি ১১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৭৩৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর আগের মাস জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ২ হাজার ৬০৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এত বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। এর আগের মাস ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ১ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। নবেম্বরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১ হাজার ৪৬৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অক্টোবরে এসেছে ২ হাজার ২৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে আসে দুই হাজার ৪৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আগস্ট মাসেও এক লাফে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ গিয়ে উঠে দুই হাজার ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। চলতি অর্থবছরের (২০১৪-১৫) প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আসে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। আকর্ষণীয় মুনাফা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, টানা অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচীর কারণে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কায় রয়েছেন। এ কারণে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের দিকে তারা ঝুঁকছেন। এছাড়া সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদহারও তাদের এখানে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে এবং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে সবাই এ খাতে ঝুঁকছেন। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রি ব্যাপক হারে বাড়ার কারণে সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার, অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ টাকা বেশি এসেছে। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়। এদিকে গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন অর্থ ধার করেনি। উল্টো বিভিন্ন সময়ে নেয়া ঋণের ৮ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে সরকারের নিট ঋণ ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে। যার পরিমাণ ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের একই সময় নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এছাড়া গত অর্থবছরের এ সময়ে বাণিজ্যক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ১৭ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিলেও চলতি অর্থবছরে এ সময় পর্যন্ত নিয়েছে মাত্র ২ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ নুরুল আমীন জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় ব্যাংক ঋণের চাপ কমছে। ব্যাংকে ঋণের চেয়ে সুদ বেশি হওয়ার জন্যই মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে সরকারও এ খাত থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঋণ পাচ্ছে। এজন্য ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম হচ্ছে। জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াতে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সুদের হার কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার। পরিবার, পেনশনার, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর ও পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করমুক্ত রেখেছে সরকার। বর্তমানে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ১১ জুন থেকে কোন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃত ভবিষ্যত তহবিলের টাকা ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার সযোগ ছিল। কিন্তু কর কমিশন কর্তৃক স্বীকৃত ভবিষ্যত তহবিল ছাড়া গ্রাচুইটি ফান্ডের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ ছিল না।
×