ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গফ হুইটল্যাম বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৩ মার্চ ২০১৫

গফ হুইটল্যাম বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

গফ হুইটল্যাম আস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের একজন সুহৃদ। বিপদের দিনের বন্ধু। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া বন্ধুবেশে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী নেতা। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় স্থান দেয়া হয় তাঁর বহুমাত্রিক গুণের জন্য। ১৯৭২ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির নেতা হিসেবে ফেডারেল পার্লামেন্টে লিবারেল পার্টির নেতা উইলিয়াম ম্যাক মোহনকে পরাজিত করে সে দেশের ২১তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৪৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার লেবার দলে যোগদান করে। ১৯৫২ সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের হাউস অব রিপ্রেজেনটিটিভ-এর সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর বিভিন্ন সময় লেবার পার্টির ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে নিজের মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় রাখেন। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে হুইটল্যাম নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মানুষের মন জয় করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতিকে করেছে সবচেয়ে শক্তিশালী। মার্কিন রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হুইটল্যাম বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যার সুফল এখনও ভোগ করছে আস্ট্রেলিয়ার মানুষ। একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর পরিচালিত নৃশংস ও বীভৎস গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে গফ হুইটল্যাম তখনকার একজন বিরোধী দলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদমুখর। ১৯৭১-এর ওই সময় চীন সফরকালে তিনি চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় স্পষ্টভাবে বাংলাদেশ ও গণহত্যা শব্দ ও বিষয় পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করে তাঁর দলের বিরোধিতার কথা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন। হয়তবা তখন চীনের সরকার কর্তৃক পাকিস্তানী হানাদার সরকারকে সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতার বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করার জন্য তিনি বাংলাদেশ ও গণহত্যা শব্দগুলো বার বার উচ্চারণ করে চীন কর্তৃক পাকিস্তানী ঘাতক সরকারের প্রতি সমর্থন পরিবর্তন বা প্রত্যাহার করার প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরোধী ও বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগণের প্রতি হুইটল্যামের ছিল অপরিসীম ও অঘাত শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও দৃঢ় সমর্থন। তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশের জনগণের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা ছিল তাঁর সরকারের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ যখন ভয়াবহ বন্যার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে, গোটা দেশ যখন সম্পূর্ণ পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন, উদগ্রীব ও বিচলিত। দেশের মানুষকে এই ভয়াবহ বন্যার কবল থেকে উদ্ধার করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও ত্রাণের ব্যবস্থা না থাকায় বঙ্গবন্ধু বিচলিত অবস্থায় একদিন তার নতুন গণভবনের কার্যালয় থেকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটল্যামকে সরাসরি টেলিফোন করে কোনপ্রকার রীতিনীতি অনুসরণ না করে জরুরী ভিত্তিতে বাংলাদশের জনগণকে বাঁচানো ও রক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে চাল ও গম প্রেরণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার টেলিকথোপকথনের এবং জাতির জনকের সাহায্যের অবেদনের বিষয়টি সেদিন রাত্রে আমি আমার ভগ্নিপতি তখনকার একজন সংসদ সদস্য ও জাতির জনকের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ও সঙ্গী জননেতা মরহুম আবিদুর রেজা খান সাহেবের কাছ থেকে শুনেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটল্যামের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আবেদন ও তাতে তাৎক্ষণিক সাড়া প্রদান করে গফ হুইটল্যাম অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চাল ও গমবোঝাই জাহাজ বাংলাদেশে প্রেরণ করেছিলেন। অপরদিকে বিশ্বের তথাকথিত মানবধিকার ও জনদরদীর দেশের বিতর্কিত শাসক নিক্সন বাংলাদেশ কর্তৃক কিউবায় চটের বস্তা বিক্রয় করার অপরাধে, পিএল ৪৮০ চুক্তি মোতাবেক জাহাজভর্তি চাল এর বাংলাদেশমুখী জাহাজের গতি কিসিঞ্জার কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে পরিবর্তন করে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের বন্যাকবলিত লাখ লাখ জনগণ চাল ও খাবার থেকে বঞ্চিত হয়ে অমানবিক দুর্যোগ ও দুঃখকষ্টে দিনাতিপাত করে বহু মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করার জন্য আবেদন করলে প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটল্যাম তাঁর সরকারের কূটনৈতিক সমর্থন ও প্রচেষ্টার দ্বারা বাংলাদেশকে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করার বিষয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন। গফ হুইটল্যাম ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি ১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনায় বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তাঁর সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের জনগণ ও দেশের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা ও নির্ভেজাল মানবিক উদারতা। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন হতে অদ্যাবধি বাংলাদেশের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার অর্থিক, কারিগরি ও মানবিক সাহায্য ও সহযোগিতার পরিমান ও পরিধি অত্যন্ত সন্তোষজনক ও বন্ধুত্বপূর্ণ উদার। লেখক : প্রাবন্ধিক
×