ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নজরদারি বাড়ানোর দাবি ॥ সহযোগিতায় রয়েছে কতিপয় এনজিও

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ঘিরে জঙ্গী গোষ্ঠীর আনাগোনা

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২৩ মার্চ ২০১৫

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ঘিরে জঙ্গী গোষ্ঠীর আনাগোনা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার জনগণের জানমাল রক্ষার্থে লাগানো ঝাউবিথির সবুজ নিরাপত্তা বেষ্টনী রোহিঙ্গাদের কারণে রক্ষা করা যাচ্ছে না। আরএসওর সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি রোহিঙ্গা প্রীতি দেখানোর ফলে ওইসব ভাসমান রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মন্ত্রীর নির্দেশে পর্যটন শহর, টেকনাফ ও উখিয়ার সৈকত এলাকার ঝাউবিথি থেকে প্রশাসন রোহিঙ্গাদের বস্তি উচ্ছেদ করে দিলেও পরবর্তীতে আরএসওর অর্থায়নে রোহিঙ্গা দরদী ওই সব ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের ফের বাসস্থান তৈরি করে দিচ্ছে। জীবন জীবিকার তাগিদে ভাসমান রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অনৈতিক, অসামাজিক কর্মকা-কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। উপকূলীয় এলাকার পর্যটন ও সামাজিক পরিবেশ ক্রমশ বিপন্ন করে ধ্বংস করছে ঝাউবাগান। এছাড়া রোহিঙ্গারা ইয়াবা, মানবপাচার, চুরি-ছিনতাই, রাহাজানি, গুম এবং হত্যাসহ বিভিন্ন বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে পর্যটন শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশ। অবনতি হচ্ছে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। টেকনাফ ও কক্সবাজারের সৈকত এলাকা থেকে প্রশাসন রোহিঙ্গা বস্তি উচ্ছেদ করে দেয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় রোহিঙ্গারা আবারও ঝাউবিথি দখল করে ঝুপড়ি তৈরি করছে। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছে আরএসও জঙ্গী গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত টেকনাফের বাহারছড়ার এক ওলামা লীগের নেতাসহ কয়েকজন চিহ্নিত রোহিঙ্গা জঙ্গী। মিয়ানমার থেকে এদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথিত অসহায় জীবনযাপনের ভিডিও চিত্র বিদেশে পাঠাতে না পারলে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় না বলে আরএসও এবং কতিপয় রোহিঙ্গা দরদী ধান্ধাবাজ নেতা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ইদানীং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও বস্তিতে জঙ্গী গোষ্ঠীর আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। আরএসও নেতাদের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন অভিজ্ঞ মহল। সূত্র জানায়, শরণার্থী ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন বস্তি ছাড়াও কক্সবাজার শহর ও শহরতলীতে বিভিন্ন ভাড়া বাসায়, সৈকতের বালিয়াড়ি ও বনাঞ্চল দখল করে বাসবাসরত অন্তত দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। আরএসও জঙ্গীরা ওইসব রোহিঙ্গাদের মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি কাজে ব্যবহার করে থাকে। সরকার টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্প এবং বস্তির শরণার্থীসহ ভাসমান রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ওইসব রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া এখনও শুরু করতে পারেনি প্রশাসন। এ সময়ে নিষিদ্ধ তিনটি এনজিও এবং আরএসও জঙ্গীরা ভাসমান রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের নামে নতুন করে শেড ও সৈকত এলাকায় বাসস্থান তৈরির ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। আরএসও এবং কিছু এনজিও সংস্থার পক্ষে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে স্থায়ীকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে সরকারের স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্তসহ সীমান্তে মিয়ানমার নাগরিকদের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ মহল। সচেতন মহল জানান, এমনিতে প্রতিদিন কক্সবাজার ১৭ ও টেকনাফ ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিকদের আটক করে সেদেশে ফেরত পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছে। তদুপরি আরএসওর অর্থায়নে জঙ্গী গোষ্ঠীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোহিঙ্গারা জামাই আদরে দিনাতিপাত করছে জেনে মিয়ানমার থেকে সেদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকে অনুপ্রবেশে আগ্রহী হয়ে উঠছে। জঙ্গী গোষ্ঠী ও কতিপয় এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিদের অপতৎপরতায় অবৈধ রোহিঙ্গাদের ফের শেড ও বস্তি তৈরি করে জামাই আদরে রাখা হলে স্থানীয়দের নাগরিক অধিকার বিপন্ন হবে। সরকারীভাবে নেয়া সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা স্থানান্তর প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞজনরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন । প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নাফনদী ও পাহাড়ী জনপদ অতিক্রম করে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে উখিয়া-টেকনাফ, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। ওই সময় সরকার ২০টি ক্যাম্প স্থাপন করে ওই সব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ে দফায় দফায় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়। পরবর্তীতে স্বার্থান্বেষী মহল, জঙ্গী গোষ্ঠী আরএসও এবং ইউএনএইচসিআরের কতিপয় প্রতিনিধির প্ররোচনায় বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হলে এক পর্যায়ে ২০০৫ সালে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে যেতে পারেনি তাদের দেশে। আবার ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি সময়েও প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে কুতুপালং ও লেদা এলাকার বনভূমির পাহাড়ে ঝুপড়ি বেঁধে আশ্রয় নেয়। ওই সময় জেলা প্রশাসক, বন বিভাগ ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চাইলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদে ব্যর্থ হয় স্থানীয় প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ জয়নুল বারী ওইসব রোহিঙ্গাদের অবৈধ আখ্যায়িত করে তাদের কোন প্রকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণসহ সাহায্য সহযোগিতা না করার জন্য এনজিও সংস্থাগুলোর প্রতি কড়া নির্দেশ প্রদান করেন। অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণীর প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় তিনটি এনজিও রোহিঙ্গাদের গোপনে ও প্রকাশ্যে সাহায্য সহযোগিতা করার মাধ্যমে স্বদেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে দীর্ঘদিন ধরে। এদিকে ১৯৯১ সালে কক্সবাজার জেলাব্যাপী মহা প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তা-বে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ক্ষয়ক্ষতি হয় গবাদিপশু বসতবাড়িসহ নানা প্রকার স্থাপনার। এসব কিছু মাথায় রেখে সরকার উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলোর জানমাল রক্ষার্থে জেলার উপকূলীয় এলাকায় ঝাউগাছ রোপণ করে। ওই ঝাউবাগান বর্তমানে উপকূলবাসীর সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি পর্যটনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ঐ ঝাউগাছগুলো নিরাপত্তা হিসেবে কাজ করছে উপকূলে বসবাসরত লক্ষাধিক পরিবারের। উপকূলবাসীর দাবী স্থানীয় ৮৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার সবুজ বেষ্টনী এখন রোহিঙ্গাদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। ওইসব রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ে আসা না হলে অদূর ভবিষ্যতে উপকূলীয় এলাকা রাহুমুক্ত করা যাবে না। রোহিঙ্গারা অভাবের কারণে টাকার বিনিময়ে ঝাউগাছ কর্তন করে বিক্রি করায় সবুজ বেষ্টনী অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উখিয়া উপজেলার উপকূলের মনখালী সেতু উদ্বোধন করতে এসে যত্রতত্র স্থাপনা দেখে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পর্যটন পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে মেরিন ড্রাইভের পশ্চিম পার্শ্বের ঝাউবাগানের সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার নিদের্শ প্রদান করেন তিনি।
×