ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাম্প্রদায়িক আগুনে পোড়া বাংলা, তবু স্বপ্নের কথা বলছে ফিনিক্স পাখি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২১ মার্চ ২০১৫

সাম্প্রদায়িক আগুনে পোড়া বাংলা, তবু স্বপ্নের কথা বলছে ফিনিক্স পাখি

মোরসালিন মিজান ॥ সেই কবে শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ! দানব রাষ্ট্র পাকিস্তানকে আজ থেকে ৪৩ বছর আগে প্রত্যাখ্যান করেছে বাঙালী। জন্ম নিয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তবে স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়নি। এখনও সাম্প্রদায়িকতা নামক দ্বৈত্যটি হা করে আছে। এই ছুঁতোয়, ওই গুজবে হামলে পড়ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। কিছু দিন পর পরই গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাঁদের ঘর, মন ও উপাসনালয়। এরপর সাময়িক মাতম চোখে পড়ে বটে! কাজের কাজটি করতে তেমন কেউ এগিয়ে আসে না। সে জায়গায় একটু ব্যতিক্রম বলতেই হয় ‘আমরা’ নামের সংগঠনটিকে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গুটিকয় তরুণ একত্রিত হয়ে গড়েছেন। সবারই রাজধানী শহরে বাস। তবে দেশের যে প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হামলা, কাজকর্ম ফেলে সেখানে ছুটে যান তাঁরা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সেই সঙ্গে চলে ছবি তোলার কাজ। সাম্প্রদায়িক হামলার পর তোলা এমন বেশ কিছু ছবি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে ধানম-ির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। লা গ্যালারিতে শুক্রবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন। সঙ্গে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী। গ্যালারি ঘুরে দেখা যায়, অল্প কিছু ছবি। তবে অনেক কিছু ধারণ করে আছে। প্রথমেই চোখে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কয়েকটি পোস্টার। বিখ্যাত একটি পোস্টারের বলাটি এরকমÑ বাংলার হিন্দু/বাংলার খ্রীস্টান/বাংলার বৌদ্ধ/বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই বাঙালী। না, শুধু বলা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হওয়ার কথা ছিলÑ এখানে তা স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়াস। এর পরের ছবিতে আজকের বাস্তবতা। বিভিন্ন পত্রিকার কাটিংয়ের কোলাজ উপস্থাপনা দেখে লজ্জায় মাথা যেন নুইয়ে আসে। শিরোনামগুলো এরকমÑ ‘বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলা আগুন প্রতিমা ভাংচুর’, ‘বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ॥ বৃদ্ধার মৃত্যু’, ‘পাহাড়ি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ’, ‘ভাস্কর্য ও শহীদ মিনার ভাংচুর...’। এরপর সেই সব হামলার আলোকচিত্র। পাশাপাশি সাজানো। একটি ছবিতে ২০১৩ সালে খুলনার কয়রায় সাম্প্রদায়িক হামলার দৃশ্য। ধ্বংসলীলা দেখে মনে হয়, বিরাট কোন সাইক্লোনের আঘাতে সব ল-ভ- হয়ে গিয়েছে। আসলে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া বাড়িঘর, আসবাবপত্র, খাট, ড্রেসিং টেবিল পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। পাশের ছবিটি দিনাজপুরের কারনাই থেকে তোলা। এখানে আস্ত বাজার জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। আগুনে পুড়ে টিনও কাগজের মতো কুকড়ে গেছে। রাঙামাটির নানিয়ারচরে যে হামলা, তা দেখে গা শিউরে ওঠে! একটি ছবিতে পুড়ে ছাই বসতভিটা। পাশেই সন্তান কোলে দাঁড়িয়ে আছেন নির্বাক মা। পাশে প্রায় একই রকম আরেকটি ছবি। এখানে পুড়ে ছাই রান্নাঘর। ভাতের হাঁড়িও কুকড়ে গেছে। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালিতেও ভয়ানক সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। একটি আলোকচিত্রে দেখা যায়, এমনকি গবাদিপশুও রক্ষা পায়নি ধর্মের নামে দেয়া আগুন থেকে। সেলাইমেশিনের লোহার কাঠামো। সেটিও পুড়ে হাজার বছরের পুরনো চেহারা পেয়েছে। কিছু ছবি বলছে ২০১৪ সালে যশোরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার কথা। তবে গ্যালারির একটি দেয়ালের কথা আলাদা করে বলতে হয়। এই দেয়ালের ছবিগুলোতে দেখা যায়, সব ধর্মই আক্রান্ত! বৌদ্ধমূর্তি ভাঙ্গা হয়েছে। হিন্দুদের দেব-দেবীর মু-ু কেটে নেয়া হয়েছে। ধর্মান্ধদের দেয়া আগুনে এমনকি পুড়ে গেছে নিজেদেরই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে তোলা একটি ছবিতে এমন দৃশ্য উঠে আসে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই মন বিষন্ন হয়ে উঠে। তবে আয়োজকরা এখানেই শেষ করেন না। আশার কথা দিয়ে সমাপ্তি টানেন। শেষ ছবিতে দেখা যায়, ধ্বংসের উপর নির্মাণের ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বাঁশ দিয়ে নতুন করে বাড়ি নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছেন সংগ্রামী মানুষ। এদের আয়োজকরা বলছেন ‘ফিনিক্স পাখি’। এই ফিনিক্স পাখিদের জয় হোক- আমাদের তাই প্রত্যাশা। বিশেষ প্রদর্শনী ২৮ মার্চ পর্যন্ত চলবে।
×