আমার বন্ধুর ছেলে শিক্ষকতা করত। ভালই করছিল। পরে দেখি আমার বন্ধু তাকে বাধ্য করছে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। আমি কারণ জিজ্ঞেস করায় জানাল, পরিবারে প্রশাসন ক্যাডারে একজন থাকলে ভাল হয়। ‘এত ঝামেলা করে শালারা যে বলার নয়।’ কয়েকদিন পর তার বাসার সামনে দু’টি সাইনবোর্ড দেখতে পাই, তাতে লেখা অধ্যাপক আবদুল করিম। আরেকটি- আবদুর রহিম বিসিএস (প্রশাসন)।
পাকিস্তান আমলে বাঙালী মধ্যবিত্ত যে চাইতেন তাঁর সন্তান হাকিম হোক তার কারণ এই একটিই। এখনও তাই চান অধিকাংশ পরিবার বা পাস করা তরুণরা।
আমার এক কনিষ্ঠ সহকর্মী হঠাৎ দেখি পুলিশ সার্ভিসে চলে গেছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। পরে, অনুধাবন করলাম, যেহেতু সে হিন্দু তার ধারণা হয়েছে নিজ পরিবার বা সম্প্রদায়কে কিছুটা হলেও মুসলমানদের এই দেশে রক্ষা করতে পারবে যদি নিরাপত্তা সার্ভিসে সে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী কলেজে আমার বহু ছাত্র শিক্ষকতা করছেন। চার দশক শিক্ষকতা করছি, কম তো নয়। কিন্তু লক্ষ্য করছি, সবাই প্রশাসনে যেতে চায়। তাঁদের বাসনা ছিল প্রশাসন ক্যাডার, পেয়ে গেছে শিক্ষা ক্যাডার। চাকরির বাজার আক্রা তাই নিয়েছে, কিন্তু মনে মনে অখুশি। কারণ শিক্ষা ক্যাডারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসন ক্যাডার। ব্যবস্থা এমনই করা হয়েছে। ফলে, শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকটি পরিপূর্ণ শিক্ষক হয় না।
এখন দেখি প্রশাসনিক ক্যাডারে যেতে শুধু সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই নয়, প্রকৌশলী, ডাক্তাররাও আগ্রহী। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এটি হয়। আমাদের দেশে একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলী তৈরিতে কত অর্থ ব্যয় হয় তা যদি তারা অনুধাবন করে থাকে তা হলে সে ঐ চাকরিতে যেতে পারে না। প্রকৌশল, ডাক্তারী পড়ে একজন স্বাধীন পেশা বেছে নেবে সেটিই তো স্বাভাবিক। সেটি এখন আর হয় না। আবার চাকরিতে ঢুকে সরকারী খরচে তারা পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে আসে যেটি রাষ্ট্রের অর্থের অপব্যবহার।
আরও আছে। কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। সরকারী পদধারী কেউ এলে সবাই অস্থির হয়ে ওঠে। বিনা কারণে বিগলিত হয়ে ওঠে। আর যিনি পদে আছেন, তিনি মনে করেন, তিনি ছাড়া সবাই তুচ্ছ। কোন মন্ত্রী সাধারণ মানুষের মতো ব্যবহার করলে তার সহকারী সচিবও তাকে উপেক্ষা করেন। কিন্তু মন্ত্রী যদি হয় পোশাকধারী, হামবড়া স্বভাবের, তাকে শ্রদ্ধা করেন। ব্যাপারটা ঐ রকম আর কি! পাকিস্তান আমলে, কোন বাঙালী যদি কোন ড্রাইভার বা পিয়নের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন তখন মনে করা হতো, কর্তাটি ব্যক্তিত্বহীন। কিন্তু তিনি যদি বলতেন ঘন ঘন, ‘এই শূয়ারকা বাচ্চা কাহা হ্যায়?’ তখন গালি খাওয়া ব্যক্তিটি খুশি হয়ে বলত, ‘না, স্যারের পার্সোনালিটি আছে।’
এ মনোভাবের এখনও তেমন পরিবর্তন হয়নি।
বিষয়গুলো কেউ অনুধাবন করেন না। এই মনোভাবের আরেকটি বড় কারণ, সরকারী চাকরি সহজে যায় না। চাকরি পাওয়া যত সহজ, চাকরি যাওয়া তত কঠিন। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি করলেও কিছু হয় না। সর্বশেষ উদাহরণ, মুক্তিযুদ্ধের সম্মান স্মারক ও সার্টিফিকেট জালিয়াতি। সচিব থেকে কাউকেই অভিযুক্ত করা হয়নি, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও। সবাই বাড়ি-গাড়ি করে ফেলতে পারে ৫০ পেরুবার আগে।
গত দু’দশক বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রেও একটি বিষয় লক্ষ্য করছি। আমরা যারা স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে যোগ দিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের মধ্যে এই মনোভাব লক্ষ্য করিনি। এখন সবাই একটি পদ চায় নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং রাজনীতিবিদদের বন্দনা করলে উপাচার্য হওয়া যায়।
গত এক দশকে যাঁরা উপাচার্য হয়েছেন, তাঁরা অধ্যাপক বটে কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রে কী অবদান তাঁদের তা বোঝা দুষ্কর। তাদের অধিকাংশকে দেখেছি শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবের কাছে গিয়ে ধরনা দিতে পদটির জন্য। এ দৃশ্য আমার কল্পনার বাইরে। শুধু তাই নয়, গত দু’দশক লক্ষ্য করছি তারা বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের ডি.জি. বা মহাপরিচালক হতে আগ্রহী। এ মানসিকতা প্রতিবেশী দেশেও তেমন দেখিনি।
পৃথিবীর সব দেশে মানুষ চিন্তা করে কখন অবসরে যাবে এবং জীবনটা উপভোগ করবে নিজের মতো করে। এ দেশে সরকারী চাকরি থেকে কেউ অবসর নিতে চায় না। অবসর নেয়ার আগের বছর সর্বাত্মক চেষ্টা চলে কিভাবে চুক্তিবদ্ধ নিয়োগ পাওয়া যায়। না পেলে, নিজের নয়, পরিবারে নেমে আসে অমানিশা। অবসর গ্রহণের বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না বাঙালী। অবসরের পরই দেখা যায় অবসরপ্রাপ্তের ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে শরীর-মন।
আমাদের জেনারেশনের মধ্যবিত্তদের মধ্যে আরেকটি ঝোঁক লক্ষ্য করেছি। আমরা মফস্বলের সামান্য স্কুলে লেখাপড়া করেছি, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকদের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পেতে অসুবিধা হয়নি। যুদ্ধ-বিগ্রহ-দুর্ভিক্ষ-বিশৃঙ্খলা সব পেরিয়ে নিজেদের পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেয়েছি ১৯৭৩-৭৪-এর মধ্যে। তারপর সবাই বিয়েটিয়ে করে সংসার পেতেছে যে যার কক্ষপথে ঘুরছে।
এক দশক পর দেখি, অধিকাংশ ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়েছে এ লেভেল/ও লেভেলে। তাদের বাবা-মা অসম্ভব বাঙালী, রবীন্দ্রনাথের ভক্ত, বাংলার জন্য প্রাণ কাঁদে। অনেকে এনজিও করে গরিব দুঃখীদের মাঝে কাজ করছেন। কিন্তু ছেলেমেয়েকে ধার করে হলেও পড়াচ্ছেন ইংরেজী স্কুলে। প্রতি দশকে এ সংখ্যা শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে।
না, এখানেই শেষ নয়, এ লেভেল/ও লেভেল পাস করলেই বিদেশে পাঠানোর প্রাণান্ত চেষ্টা বিশেষ করে ইউরোপ বা আমেরিকায়। ছেলেমেয়ে ভাঙ্গা বাংলা বলে বা বাংলা ঠিকই বলে তেমন পড়তে পারে না আর কি। বিদেশে সবাই যে আহামরি চাকরি করে তা নয়, কিন্তু কী গর্ব তাঁদের! আমি এই মানসিকতা এখনও বুঝতে পারিনি। এই গরিব দেশের টাকায় সব তৈরি করে বিদেশ পাঠানোÑ স্বাধীন দেশের মানুষের তো এ মানসিকতা হওয়ার কথা ছিল না।
আগে যেমনটি উল্লেখ করেছি, উনিশ শতকে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শাসকদের শিক্ষা-সংস্কৃতি রুচি তুলে ধরেছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রভাব অন্বেষী ছিল তারা এবং স্বভাব ছিল সমঝোতাপূর্ণ। আজ দু’শ’ বছর পর দু’বার স্বাধীন হওয়ার পরও মধ্যবিত্ত এবং স্বাধীন দেশে সৃষ্ট নতুন মধ্যবিত্তের মনোভাবেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন এলো না। একটি উদাহরণ দিই।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কথা যখন এ দেশের মধ্যবিত্ত আলোচনা করে তখন দু’জনকে একইভাবে বিচার করে এবং যত খুঁত খুঁজে পায় শেখ হাসিনার। কারণ, তাঁদের অবচেতনে কাজ করে খালেদা জিয়া একজন লে. জেনারেল ও সামরিক শাসকের স্ত্রী ছিলেন। এবং তিনি হুকুম করতে ভালবাসেন। ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করে শোভন রুচির পরিচয় হয়ত তিনি দেননি। কিন্তু তাতে কী? বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হতে পারেন। প্রেসিডেন্ট হতে পারেন; কিন্তু সামরিক শাসক তো ছিলেন না। গরিব গুর্বোদের নিয়ে চলেছেন, তার মেয়ের স্বভাবও সে রকম। অবচেতনভাবে সে যুক্ত হয় পাকিস্তানী সংস্কৃতির সঙ্গে। আর পদে থেকে বাঙালী কখনও নিজেকে সামান্য ভাবতে পারে না।
যতদিন পদের মহিমা নিয়ে আমরা মত্ত থাকব ততদিন ধরে নিতে হবে- স্বাধীন হয়েছি, অর্থনীতির উন্নয়ন হচ্ছে; কিন্তু ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন থেকে মুক্তি পাচ্ছি না।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: