ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিয়ানমার থেকে মাথাকাটা চিংড়ি আসার জের

কক্সবাজারে চিংড়ি ব্যবসায় ধস

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২১ মার্চ ২০১৫

কক্সবাজারে চিংড়ি ব্যবসায় ধস

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার থেকে মাথাকাটা চিংড়ির চালান আসার কারণে মৌসুমের শুরুতে দেশীয় চিংড়ি ব্যবসায় ধস নেমেছে। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন ঘেরে উৎপন্ন হওয়া চিংড়ির ন্যায্যমূল্য না পেয়ে মৌসুমের শুরুতে লোকসানের মুখে পড়ছে হাজার হাজার চাষী ও চিংড়ি ব্যবসায়ী। কক্সবাজার মিয়ানমার ভিত্তিক গঠিত মাত্র চার সদস্যের সিন্ডিকেট মিয়ানমার থেকে মাথাকাটা চিংড়ি আমদানি করে গোটা জেলার চিংড়ি চাষাবাদ ও ব্যবসায় জড়িত হাজার হাজার মানুষকে এ সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটে রয়েছে কক্সবাজারে চিংড়ি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের দুই মালিক ও দুইজন ব্যবসায়ী। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় মাথাকাটা চিংড়ি গ্রহণ করা সরকারীভাবে নিষিদ্ধ হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি অনুমতিপত্র এনে সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার কেজি মাথাকাটা চিংড়ি দেশে প্রবেশ করাচ্ছে নির্বিঘেœ। সুদূর আকিয়াব (সিটওয়ে) থেকে মাথাকাটা চিংড়ি কক্সবাজারে এনে রিসিভ করা হলেও কক্সবাজারে বিভিন্ন ঘেরে উৎপন্ন চিংড়িগুলোর ওপর সেই নিষেধাজ্ঞা বলবত রয়ে গেছে এ পর্যন্ত। দেশে উৎপন্ন চিংড়িগুলো রিসিভ করা হয়ে থাকে মাথাসহ। সরকারের নিষিদ্ধ ঘোষিত মাথাকাটা আইন তোয়াক্কা না করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত চিঠির নামে অহরহ দেশে আনা হচ্ছে মাথাকাটা খোলা (প্রসেসিংবিহীন) চিংড়ির চালান। ওই সিন্ডিকেটের কারণে কক্সবাজারে চিংড়ি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বৈতনীতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। অভিযোগ রয়েছে, পরিদর্শনে আসলে চিংড়ির প্যাকেট ও মাসিক চুক্তির টাকা ধরিয়ে দেয়ার কারণে মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অনেকে এসব দেখেও দেখে না। কক্সবাজারে চিংড়ি মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নেই। তবে চট্টগ্রাম থেকে মাঝে মাঝে কক্সবাজারে ফ্যাক্টরিতে এসে পরিদর্শন করে থাকেন বলে মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে। মিয়ানমারের মাথাকাটা চিংড়ির কারণে কক্সবাজার জেলা ও উত্তরবঙ্গের চিংড়ি ব্যবসায় জড়িত অন্তত দুই লাখ মানুষ কর্মহীন এবং আর্থিক সঙ্কটে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানায়, ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা মাথাকাটা চিংড়ি স্বল্প মূল্যে এবং গ্রেডে সুবিধা করতে পারে বেশি। ফরমালিন ও ক্লোরিন মিশানো মিয়ানমারের চিংড়ির গুণগতমান খারাপ হলেও ফ্যাক্টরিতে এনে প্রসেসিং শেষে দেশীয় উৎপাদিত চিংড়ির সঙ্গে মিশিয়ে রফতানি করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওইসব চিংড়ি মিয়ানমার থেকে দেশে প্রবেশ করানোর পর একজন মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে কীট পরীক্ষা করিয়ে খোলা চিংড়িগুলোতে কোন ধরনের ফরমালিন বা ক্লোরিন নেই বলে সনদ হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট সদস্যরা। চিংড়ি চাষীরা জানায়, মিয়ানমারের মাথাকাটা চিংড়ির চালান দেশে আনার সুযোগ করতে পারলেই বহির্বিশ্বে রফতানি না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছে করে চিংড়ি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো মাছের দাম ও গ্রেড কমিয়ে দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদা মতে চিংড়ি নেই এবং শ্রমিকদের বেতনসহ ফ্যাক্টরি টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না ইত্যাদি ভুয়া তথ্য দিয়ে মিয়ানমার থেকে মাথাকাটা চিংড়ির চালান দেশে আনার অনুমতি পত্র হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট সদস্যরা। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন জনকণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমারের মাথাকাটা চিংড়ি দেশে প্রবেশ বন্ধ করা দরকার। এর আগে এটি নিষিদ্ধ ছিল। তবে কিভাবে তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে আসে- তা বোধগম্য নয়। কারণ ওইসব চিংড়ির গুণগতমান কঠোরভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষার দরকার রয়েছে। টেকনাফে শুধু ফরমালিন পরীক্ষা করে থাকেন আমাদের একজন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা। মিয়ানমারের অনুন্নত ওইসব মাথাকাটা চিংড়ি সরকারীভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিত। দেশে উৎপন্ন হওয়া চিংড়ির মান অত্যন্ত ভাল। মৎস্য কর্মকর্তাদের তদারকিতে উৎপন্নও হয় বেশি। তবে কেন তারা মিয়ানমারের চিংড়ি আনতে মরিয়া, তা উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত টিম গঠন করে যাচাই করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমের শুরুতে মিয়ানমারের অনুন্নত চিংড়ির চালান দেশে প্রবেশ আরম্ভ হওয়ায় জেলার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি ঘেরে উৎপাদিত মাছ উপায়ান্তর না দেখে খোলা বাজারে বিক্রি করছে চাষী ও ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছে, স্বল্প দামে এবং সহজ গ্রেডে মিয়ানমারের চিংড়ি রিসিভ করে হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা পাঠানো হচ্ছে সেদেশের পার্টির কাছে। অথচ ইতোপূর্বে সরবরাহকৃত চিংড়ির মূল্য বাবদ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের এখনও লাখ লাখ টাকা অনাদায়ী পড়ে রয়েছে কারখানার ফাইলে। এদিকে চলতি মৌসুমে ভাল দাম পাওয়ার আশায় চাষীরা স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক, ঋণ ও চিংড়ি এজেন্টের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা দাদন নিয়ে ঘেরে সাইজে বড় করে চিংড়িগুলো বিক্রির শুরুতে চাষীদের গুনতে হচ্ছে বিপুল লোকসান। এতে নিরাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়েছে চাষীদের অনেকে। উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী ও চকরিয়ায় চলতি মৌসুমে প্রায় ৩ হাজারটি ঘেরে বাগদা চিংড়ির চাষ করা হয়েছে। ওইসব ঘেরে কয়েক হাজার শ্রমিক ছাড়াও প্রতি মৌসুমে শুধুমাত্র বাগদা চাষের ওপর নির্ভরশীল জেলার উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া ‘জো’ (মাছ ধরা পড়ার দিনক্ষণ) এ হাজার হাজার কেজি বাগদা চিংড়ি ধরা পড়লেও কক্সবাজারে গড়ে ওঠা ফ্যাক্টরিগুলোতে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ব্যবসায়ী ও চাষীরা চিংড়িগুলো কম দামে বিক্রি করছে খোলা বাজারে। ব্যবসায়ীরা জানান, গত মৌসুমে যে সকল সাইজের চিংড়ি মাছ প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ক্রয় করে বিদেশে রফতানি করত, তা এখন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন খোলা বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে। তারা আরও জানান, মৌসুমের শুরুতে মিয়ানমারের মাথাকাটা চিংড়ির চালান আনার অনুমতি পেয়ে কক্সবাজারে হাতেগোনা ৩টি চিংড়ি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান লোকাল ঘেরে উৎপন্ন চিংড়ির দাম কমিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বর্তমানে রফতানি হচ্ছে না এ অজুহাত দেখিয়ে ফ্যাক্টরিগুলোতে কম দামে চিংড়ি ক্রয় করছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফ্যাক্টরি মালিক জানান, বহির্বিশ্বে ছোট সাইজের মাছ রফতানি না হওয়ায় তা ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। মিয়ানমারের মাছগুলো সাইজে বড় হওয়ায় তা আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করছে অনেকে।
×