ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঘন্য আম্পায়ারিং!

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ মার্চ ২০১৫

জঘন্য আম্পায়ারিং!

মিথুন আশরাফ ॥ বাংলাদেশকে যেন জোর করে হারাতেই দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই আম্পায়ার ইংল্যান্ডের ইয়ান গোল্ড ও পাকিস্তানের আলিম দার। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন থার্ড আম্পায়ার অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ ডেভিসও। আম্পায়াররা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে গেলেন। সেই সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্নে একে পর এক আঘাত হানতে থাকল। একটা সময় ভারতকে হারানোর স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। হারতে হলো ১০৯ রানে। বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের বিদায় ঘটল। ভারত উঠে গেল সেমিফাইনালে। বৃহস্পতিবার কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টিম ইন্ডিয়ার সঙ্গে খেলেছেন আম্পায়াররা। সুরেশ রায়নার এলবিডব্লিউ না দেয়া, রোহিত শর্মা আউট হওয়ার পরও অহেতুক ‘নো’ ডাকা, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আউট না হওয়ার পরও আউট দেয়া, এ সবই আম্পায়ারদের ভুল সিদ্ধান্ত। সেই ভুলের খেসারত দিতে হলো বাংলাদেশকেই। ১০৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হার। কিন্তু খোদ ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিও (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা) যেন আম্পায়ারদের সঙ্গে তাল মেলাল। বাংলাদেশকে বিদায় করে দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করা ভারতকে সেমিফাইনালে তুলতে যে উঠে পড়ে লেগেছিল, তা একটি বিজ্ঞাপনই পরিষ্কার করে দেয়। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে খেলা চলার সময় সাইড স্ক্রিনে হঠাৎ ভেসে ওঠে বিজ্ঞাপনটি। ‘জিতে গারে জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা!’ এটা কোনভাবেই আইসিসি করতে পারে না। দুটি দেশের খেলা চলছে। সেখানে আইসিসির যে কোন বিজ্ঞাপন প্রচার হতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই মাঠে খেলা দুই দলের নির্দিষ্ট একটি দলের পক্ষে বিজ্ঞাপন প্রচার হতে পারে না। আইসিসিও বুঝিয়ে দিল ভারতের পক্ষেই ছিল তারা। সেখানে বাংলাদেশের আর কী করার থাকতে পারে। আম্পায়াররা যে ভুল করেছেন, তা আরও স্পষ্ট হলো, যখন খোদ আইসিসি সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল আম্পায়ারদের ভুল সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন। বললেন, আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট তিনি। পরবর্তী আইসিসি সভাতেই এ বিষয়টি তুলবেন। প্রয়োজনে আইসিসি সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগও করবেন! আইসিসি সভাপতিই ত্যক্ত-বিরক্ত আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তে। সেখানে দেশের মানুষত আম্পায়ারদের কুশপুতুল পোড়াবেনই। বাংলাদেশে আম্পায়ারদের সমালোচনা নিয়ে ঝড় উঠছে। শুধু কী দেশে, বিদেশেও এর প্রভাব ভালভাবেই পড়ছে। রোহিত যে ক্যাচ আউট হলেন এবং আম্পায়ার ইয়ান ‘নো’র সিদ্ধান্ত দিলেন, তা যে ঠিক হয়নি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন সাবেক ক্রিকেটাররা। নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাইকেল হোল্ডিং তো অবাক হয়েছেন। বলেছেন, ‘এটা কোনভাবেই নো নয়।’ পুরো ক্রিকেট বিশ্বে এখন আম্পায়ারদের সমালোচনা চলছে। সেখানে ভারত কিন্তু নীরবই। তা থাকারই কথা। সব সিদ্ধান্ত যে তাদের পক্ষেই গেছে। ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ করে এখন তিন ‘মোড়ল।’ প্রধান মোড়ল বলা হয়ে থাকে ভারতকে। তার দুই সহযোগী ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এতটাই ভাল খেলেছে যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। আর ইংল্যান্ডকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালেই খেলা নিশ্চিত করে নেয় বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুই মোড়লের কাছে হার হয়নি। এখন যদি প্রধান মোড়লের কাছেও হার না হয়, তাহলে তো র‌্যাঙ্কিংয়ে নিচের সারির দল বলে যে বাংলাদেশকে হেলা করা হয় তা যে একেবারেই ঠিক নয়, সেই প্রমাণই মিলে যাবে। আইসিসিকে মোক্ষম জবাবও দেয়া হয়ে যাবে। তিন মোড়লের কাছেই সেই সঙ্গে হার না মানার নজির গড়বে বাংলাদেশ। তাই আইসিসিও যেন বাংলাদেশকে হারানোর চক্রান্তেই শামিল হয়। তা না হলে কেন একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তগুলো ভারতের পক্ষেই যাবে। আবার খেলা চলাকালে ভারতের পক্ষে বিজ্ঞাপন অমন দেখানো হবে কেন? আইসিসির মনোনীত আম্পায়ারদের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এরই মধ্যে। সেই সঙ্গে ভারতকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টিকিয়ে রাখতে যে সব চেষ্টাই করা হয়েছে, তা বোঝাই যাচ্ছে! শুরু থেকেই ম্যাচে বাংলাদেশ প্রাধান্য বিস্তার করে খেলে। ভারতের ব্যাটিং চলাকালে দুবার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়ে বাংলাদেশের উজ্জীবিত ক্রিকেটে জল ঢেলে দিয়েছেন আম্পায়াররা। যে ভারত ২৫ ওভারেও ১০০ রান করতে পারেনি, আম্পায়ারদের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত ভারতের পক্ষে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ৫০ ওভারে ৩০২ রান করে ফেলে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের বিপক্ষেও দেয়া হয়েছে এক বিতর্কিত আউটের সিদ্ধান্ত। যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ইনিংসে ভালভাবেই প্রভাব ফেলে। শুরুটা হয়েছিল সুরেশ রায়নার বিপক্ষে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার এলবিডব্লিউ আউটের আবেদন দিয়ে। ৩৪তম ওভারে ওই আবেদনটি করেছিলেন মাশরাফি। রিভিউও নেন। তখন ভারতের রান মাত্র ১৪৭। ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে ভারত। সুরেশ রায়নারও রান তখন মাত্র ১০। নিয়মের ফাঁদে ফেলে সিদ্ধান্তটি বাতিল করে দিয়েছেন টিভি আম্পায়ার স্টিভ ডেভিস। মাশরাফির বলটা লেগ স্টাম্পের সামান্য বাইরে পড়েছিল। আর তাতেই নিয়ম দেখিয়ে উইকেট বঞ্চিত বাংলাদেশ। নিয়মটা হলো, লেগ স্টাম্পের বাইরে বল পড়লে কোন এলবিডব্লিউ নয়। কিন্তু মাশরাফির এই আবেদন নিয়ে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার বলেছেন, ‘নিয়মের দিক থেকে সিদ্ধান্তটা ঠিক, নীতির দিক থেকে ঠিক নয়।’ আর ক্রিকইনফো বলেছে, ‘এটা অনেক বেশি ক্লোজড কল ছিল। ৫১ শতাংশই আউট।’ কিন্তু ডেভিস আউট দিলেন না। নিয়মের কথা বলে আরেকবার আম্পায়ারের বাজে সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। ৪০তম ওভারে রুবেলের একটি বলে ক্যাচ তুলেছিলেন ম্যাচে সেঞ্চুরি পাওয়া রোহিত শর্মা। তখন তার ব্যক্তিগত রান ৯০। বাংলাদেশ ক্যাচটি ধরলেও তা ‘নো বল’ ডেকে বাতিল করে দিয়েছেন অনফিল্ড ২ আম্পায়ার ইংল্যান্ডের ইয়ান গোল্ড ও পাকিস্তানের আলিম দার। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বলটি কোমরের উপরের ছিল। কিন্তু টেলিভিশন রিপ্লেতে আম্পায়ারদের দাবির যথার্থতা মেলেনি। তবে কর্তার ইচ্ছাই কর্ম। বাংলাদেশকেও তাই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে। আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো, লেগ আম্পায়ার (আলিম দার ছিলেন) এমন ফুলটস বলে ‘নো’ ডাকেন। কিন্তু ডাকলেন ইয়ান! যখন টিভি বার বার আলিম দারের দিকে তাক করল, তিনি কিছুই বললেন না! ইয়ান ‘নো’ ডাকার পরও যদি আলিম দার তা বাতিল করতেন, রোহিত আউট হয়ে যেতেন। তখন ভারতও বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে যেত। এত রান হতো না। হারও হতে পারত ভারতের। শেষপর্যন্ত আম্পায়ার তথা ভাগ্যের আশীর্বাদ নিয়ে রায়না ৬৫ রানে এবং রোহিত ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে ভারতের সংগ্রহকে টেনে নিয়েছেন অনেক দূর। যা বাংলাদেশের মানসিক ভিত এতটাই ভেঙ্গে দেয় যে এরপর ফিল্ডিংও হয় উল্টো পাল্টা। ভারতের ইনিংসে এ দুটি আউটের সিদ্ধান্ত না দেয়ায় আম্পায়ারদের নিয়ে তুখোর সমালোচনা চলছে। এমন সময় বাংলাদেশ ইনিংস যখন দাঁড়ানোর সময় তখন আরেকটি বাজে সিদ্ধান্ত দেন আম্পায়াররা। বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংস চলাকালে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ব্যাট ছুঁয়ে বাতাসে ভাসা বলটি বাউন্ডারি সীমানায় দ্বিতীয় চেষ্টায় তালুবন্দী করেছেন ধাওয়ান। কিন্তু বলটি তিনি যখন তালুবন্দী করেছেন তখন তার পা বাউন্ডারি লাইন স্পর্শ করেছিল। কিন্তু থার্ড আম্পায়ার তা উপেক্ষা করেই মাহমুদুল্লাহকে আউট ঘোষণা করেছেন। যদিও টিভি রিপ্লেতে এবং স্টিল ফটোগ্রাফিতে স্পষ্টই দেখা গেছে ধাওয়ানের পা লাইন স্পর্শ করেছে। যারা এই আউটের সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট করেছেন তাদের দাবি বাউন্ডারি লাইন ও ধাওয়ানের পা’র মধ্যে ইঞ্চি খানেক ফাঁক ছিল। অথচ ছবি দেখলে ‘মাইক্রো ইঞ্চি’র পার্থক্যও খুঁজে পাওয়া যাবে না সেখানে! শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরাও এতটাই মানসিক দুর্বল হয়ে পড়েন, ১৯৩ রানেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। ইংলিশ আম্পায়ার ইয়ান গোল্ডত যেন ইংল্যান্ডকে হারানোর প্রতিশোধই নিয়ে নিলেন! প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমনটি কেন হলো? উত্তরটাও সোজাই। আইসিসির মূল আয়ের ৮০ শতাংশ ভারতের অবদান। এ কথা ক্রিকেট বিশ্বে সর্বজন স্বীকৃত ‘ওপেন সিক্রেট’। যে কোন আসরে ভারতের টিকে থাকা মানে আইসিসির লাভের এ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে ওঠা। মাশরাফিদের উদ্দীপ্ত ক্রিকেটের জোয়ারে মহেন্দ্র সিং ধোনিদের অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে না যায়, কে জানে হয় তো সে কারণেই আম্পায়ারদের নির্দেশনা দিয়েই মাঠে ঠেলেছে ক্রিকেটের বিশ্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। যাকে নিয়ে অনেকেই মজা করে বলে থাকেন- আইসিসি মানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নয়, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল! বৃহস্পতিবার ১৬ কোটি বাংলাদেশীর মন ভেঙ্গে দিয়েছে আম্পায়ারদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো। সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকেও দিল। দুর্দান্ত খেলতে থাকা একটি দল হঠাৎ করেই এমন নিকৃষ্ট সিদ্ধান্তগুলোর শিকার হলো। দেশজুড়ে বিক্ষোভ হওয়াটা স্বাভাবিকই। তা হচ্ছেও। তবে একটি বিষয় সবাই বলছেন, যেভাবেই হোক শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিশ্ববাসী দেখেছে কতটা অবিচার করা হয়েছে। সঙ্গে বিশ্ব ক্রিকেট যে বাংলাদেশকে কতটা ভয়ও পেল, তাও কী বোঝা গেল না? আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তগুলোতে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো ঠিক, তবে এ বিশ্বকাপে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।
×