ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ডিএসসিসির উদ্যোগ

ঢাকা দক্ষিণের হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২০ মার্চ ২০১৫

ঢাকা দক্ষিণের হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানীর ফুটপাথে ব্যবসা পরিচালনাকারী হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রায় ৫ লাখ হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে এ লাইসেন্সের আওতাভুক্ত করা হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও ঢাকার রাস্তায় চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। এর মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এর আগে এ দুই প্রকারের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করলেও ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করতে হতো না। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, কর্পোরেশন এলাকার ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সকল প্রকার ব্যবসায়ীকে বৈধ ট্রেড লাইসেন্সের আওতাভুক্ত করতে এবং হকারদের নির্দিষ্ট স্থান ও নির্দিষ্ট নিয়মে এনে ব্যবসা পরিচালনা করতে কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া এর মাধ্যমে ডিএসসিসির রাজস্ব আয়ও বর্তমানের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ডিএসসিসি তার নাগরিকদের সেবার পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় আরও বাড়াতে সক্ষম হবে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য হকারদের নির্দিষ্ট এলাকা ও সময় নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ব্যবসা করার স্থানটি নিয়মিত লাইসেন্সধারীরাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবেন। কোন এলাকায় কোন হকার ব্যবসা করবেন তা ঠিক করতে প্রতিটি হকারকে আইডি কার্ড প্রদান করা হবে। আইডি কার্ড অনুযায়ী তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে। পাশাপাশি কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সঠিক নিয়মে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে ডিএসসিসি নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পরিচালনা করবে। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ডিএসসিসি এলাকায় গুলিস্তান, মতিঝিল, দিলকুশা, চকবাজার, লালবাগ, নিউমার্কেট, গাওছিয়া, চাঁদনী চক, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা কলেজের সামনে, শাহবাগ, পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানসহ শতাধিক স্থানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার বৈধ অনুমতি ছাড়াই নিয়মিত হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করেন। প্রায় ৫ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে লাইসেন্সের আওতায় আনা সম্ভব হলে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে বলে ধারণা করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব ট্রেড লাইসেন্স সর্বনিম্ন ফি ধার্য করে ১ বছরের জন্য প্রদান করা হবে। ফি’র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ফি নেয়া হবে। বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এ লাইসেন্স দেয়া হবে। লাইসেন্স গ্রহণকারী ট্রেড লাইসেন্সে উল্লেখিত কোন শর্ত ভঙ্গ করলে তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে এবং পরবর্তীতে তাকে দ্বিতীয়বার ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হবে না। তাছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কোন শর্ত ভঙ্গ করলে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্তসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ। তবে অপর একটি সূত্র বলছে, হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ভাসমান হওয়ায় তাদের প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে ও ৬ মাসের জন্য ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হবে। নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে কি না তা নিয়মিত মনিটর করা হবে। নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশিরভাগেরই যেহেতু ঢাকায় কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই সেহেতু তাদের লাইসেন্স গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় লাইসেন্স প্রদান করা হবে। ভবিষ্যতে উক্ত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যে কোন প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হলে উক্ত ঠিকানার ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণকারীকে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। ডিএসসিসির রাজস্ব শাখার মতে, কর্পোরেশনের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এ উদ্যোগ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ডিএসসিসি এলাকায় প্রায় ২ লাখ ব্যবসায়ী ট্রেড লাইসেন্সের আওতাভুক্ত রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যবসায়ীর সংখ্যা এ সংখ্যার চেয়ে কমপক্ষে ৩ গুণ বেশি হবে। এ লাইসেন্সবিহীন ব্যবসায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্যই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে একই ব্যক্তি কয়েকটি ব্যবসা পরিচালনা করলেও একটি মাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে তা পরিচালনা করছেন। এতে করে সিটি কর্পোরেশন রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে ব্যবসায়ীরাও লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছে। সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার রাস্তাগুলোর ফুটপাথে দোকান আছে ৭৫ হাজারের মতো। তবে বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী দোকানের সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি। বেসরকারী এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে শুধু ফুটপাথের দোকান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো চাঁদা আদায় হয়। মাসে হয় ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আবার দোকানের অবস্থান বিক্রি করে মাসে আয় হয় ১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ হকার্স সমিতির সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে হকার্স স্পট রয়েছে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি। সব মিলিয়ে দিনে প্রায় ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ হিসাবে মাসে ১৮ কোটি এবং বছরে ২১৬ কোটি টাকা রাজধানীর চাঁদাবাজদের পকেটে যাচ্ছে। এর আগে তৎকালীন মেয়র মোঃ হানিফ চাঁদাবাজদের হাত থেকে হকারদের রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে আমলে তিনি ওসমানী উদ্যান, মুক্তাঙ্গন, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, মিরপুর, শাহ আলী, পান্থপথ ও আজিমপুরে মোট ৮ এলাকায় হকারদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব করেছিলেন। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোট ২০ এলাকায় পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়। তখন প্রস্তাবগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু পরে এ প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) অপর এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিমাসে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ফুটপাথগুলোতে অবস্থানরত হকাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ক্যাডারদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন। সিটি কর্পোরেশন যদি এদের ট্রেড লাইসেন্সের ব্যবস্থা করত তাহলে এ টাকা কর্পোরেশনের রাজস্ব হিসেবে আয় হতো। এ বিষয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসির নগর ভবনের সভাকক্ষে এক আলোচনা সভায় ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের (ডাব্লিউবিবি) মতে প্রতিমাসে রাজধানীর হকাররা ৩শ’ কোটি টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন। যদি কর্পোরেশন এসব হকারদের জন্য নির্ধারিত একটি আইডি কার্ড অথবা রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করত তাহলে টাকাগুলো রাজস্ব হিসেবে আয় করা যেত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা উপসচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, হকাররা বর্তমানে যত্রতত্র বসে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ডিএসসিসি এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকারদের ব্যবসা পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনতে ও কর্পোরেশনের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৫ লাখ হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে এর আওতায় আনা হবে। তাদের নির্দিষ্ট এলাকা ও সময় নির্ধারণ করে দেয়া হবে। ব্যবসা করার স্থানটি নিয়মিত লাইসেন্সধারীরাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবেন। কোন এলাকায় কোন হকার ব্যবসা করবেন তা ঠিক করতে প্রতিটি হকারকে আইডি কার্ড প্রদান করা হবে। আইডি কার্ড অনুযায়ী তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে। লাইসেন্স ফি ৩০০ থেকে ৫শ’ টাকা করে নেয়া হবে পাশপাশি কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সঠিক নিয়মে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে ডিএসসিসি নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পরিচালনা করবে। এছাড়া কর্পোরেশনের অন্যান্য শাখাও এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এটি চালু হলে ডিএসসিসির কাছে হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার পাশপাশি ডিএসসিসির রাজস্ব আয় বর্তমানের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পাবে।
×