ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদের মহিমা ॥ ঔপনিবেশিকোত্তর, ঔপনিবেশিক মন

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২০ মার্চ ২০১৫

পদের মহিমা ॥ ঔপনিবেশিকোত্তর, ঔপনিবেশিক মন

ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার ফলে বাঙালীর মননে, চিন্তায় এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে এই ঔপনিবেশিকোত্তর মনের বীজ রোপিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এর জের প্রবাহিত হয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। ॥ গতকালের পর ॥ ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যশ্রেণীর ভূমিকা এ রকমই ছিল। তারা তুলে ধরেছিল শাসকের শিক্ষা সংস্কৃতি রুচি। এই কাঠামোর তাদের প্রধান ভূমিকা আবার তাদের করে তুলেছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব অন্বেষী। কিন্তু অর্থনৈতিক পুঁজির ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এবং সামাজিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় তাদের রাজনীতি হয়ে উঠেছিল সমঝোতাপূর্ণ এবং আদর্শ বিকৃত। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়ে উঠলেও চরম কোনো পরিবর্তন এনে সমাজের আমূল পরিবর্তন করতে পারেনি। ২. এ মধ্যবিত্তের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। ১৯৪৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ঔপনিবেশিক প্রশাসনের প্রথম সারির (যেমন, সচিব) পদ থেকে কেরানী পদগুলোর অধিকাংশই পূরণ করেছিল হিন্দুরা। ঢাকার বিক্রমপুর তো পরিচিত হয়ে উঠেছিল কেরানী সরবরাহকারী অঞ্চল হিসেবে। পাকিস্তান হয়েছিলই মুসলমানদের উচ্চাশা পূরণের জন্য। কিন্তু, সেখানে আবার মুসলমানদের মধ্যে ভাগ ছিল। এক ভাগে বাঙালী মুসলমান, অন্য ভাগে পশ্চিমা বা পশ্চিমা মুসলমানরা যাদের ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানে অবিভক্ত ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। দু’একটি উদারহণ দেয়া যেতে পারে। প্রশাসনিক সার্ভিসে ১৯৬৮ সালে সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব এবং সহকারী সচিব পদে বাঙালীর হার ছিল ১৪,৬,১৮ ও ২০ ভাগ। সেনাবাহিনীতে অবস্থা এর চেয়ে ভাল ছিল না। পূর্ববঙ্গে আবার বাঙালীদের চেয়ে বিহারীদের দাপট ছিল বেশি। ব্রিটিশ পাকিস্তানী দু’আমলেই সরকারী চাকরি বা অন্য ক্ষেত্রে বাঙালীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। দু’আমলেই বাঙালীকে নিষ্পেষিত হতে হয়েছে, আমলাতান্ত্রিক শাসনের অধীনে। ব্রিটিশ শাসনের মতোই দেখা গিয়েছিল একজন মহকুমা হাকিম মহকুমার সবকিছুর দণ্ড-মু-ের কর্তা। সে জন্য, প্রতিটি সন্তানের পিতা-মাতা চাইতেন, বড় হয়ে ছেলে যেন হাকিম হয়। মুক্তিযুদ্ধের কারণে, আমলাতন্ত্র হীনবল হবে এই আশা ছিল সবার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অল্পসংখ্যক গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। কিন্তু, তখনও নীতি নির্ধারণে বা কার্যকরে তাদের একটা ভূমিকা ছিল। ঐ সময় জহুর আহমেদ চৌধুরীর একটি চিঠি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারি- Confidential Mr. Imam Administrator Eastern Zone Govt. of Bangladesh I have observed with deeper regret that your office is always overcrowded with unidentified elements. At the same time no proper attention is given by you to our M.N.A and M.P.AÕs. Even our party organising Secretary does not find aû accommodation there. After all, you should remember that you are serving the `Bangladesh Govt.Õ formed by the Awami League. I expect due courtesy to be observed by the officers and employees of this office to our leaders. This is for our future guidance. Dated 25 June 1971 Zahur Ahmed Choudhury Bangladesh Liberation Council Eastern Zone. ৩. মুক্তিযুদ্ধের পর আশা করা গিয়েছিল আমলাতন্ত্র হীনবল হয়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধু আমলাদের গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু নীতি নির্ধারণে জনপ্রতিনিধিদের দাপট ছিল বেশি। সেই নীতি কার্যকরের ক্ষমতাও ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দৃশ্যপট আবার পাল্টে যায়। সামরিক ও বেসামরিক আমলারা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। সেই থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসনামলের মতো আমলাতন্ত্র বিকশিত হতে থাকে এবং সে অবস্থা এখনও বর্তমান। উল্লেখ্য, এ আমলাতন্ত্রের কাঠামো পাকিস্তানী আমলের মতো। তারই অভিঘাত লক্ষ্য করি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ধরা যাক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিষয়ে কোন অনুষ্ঠান। সেটি সরকারী-বেসরকারী যে কোন পর্যায়ের হতে পারে। দেখা যাবে, সেখানে সংশ্লিষ্ট সচিবের একটি পদ থাকে। সাধারণত প্রধান অতিথির। অন্যদিকে জাতীয় ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বা সাহিত্য ব্যক্তিত্ব হয়ত বিশেষ অতিথি। এ বিষয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বিদেশী একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার জন্য। রাজি হলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, সেখানে আর কারা কারা থাকবেন। তিনি জানালেন, শিক্ষা সচিব ও আরও দু’একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা। অভিজ্ঞতার আলোকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার অবস্থান কী?’ জানানো হলো শিক্ষা সচিব প্রধান অতিথি, আমি বিশেষ অতিথি। আমি বললাম, ‘সেটি সম্ভব নয়। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’ আমাকে যেহেতু আমন্ত্রণ করা হয়েছে এবং তারা এই অবস্থায় আগে কখনও পড়েনি, কী করবে তারা বুঝতে পারছিল না। আমাকে আবার ফোন করলে আমি জানালাম, ‘আমি তাদের অবস্থা বুঝতে পারছি। তাদেরকে শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করতে হয়। সচিবকে ক্ষুব্ধ করা যাবে না। এর সমাধান হলো সবাই ‘সম্মানিত অতিথি’, সেটিই বহাল থাকল। আমি বা হাশেম খান যখন কোন অনুষ্ঠান করি, তখন এই প্রথাই অবলম্বন করি এবং তাতে কারও অসন্তোষ দেখিনি। কিন্তু এটি কেন করা হয়, এখনও? কারণ, পদের মহিমা। ধরে নেয়া হয় তিনি সরকারী পদে আছেন, সুতরাং তাঁর ক্ষতি করার ক্ষমতা বেশি। বা তাঁকে এভাবে তোয়াজ করলে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যেতে পারে। একেবারে ক্রীতদাসের মন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দেখা যায়, বিভিন্ন সারিতে ফলক লাগানো থাকে। এখন ধরা যাক, সে অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক বা হাশেম খান এলেন। তাঁরা কোথায় বসবেন? সবচেয়ে পেছনের সারিতে। তাতে তাঁদের আপত্তি নেই। কারণ, ঐসব বিষয়ে তাঁদের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু, তাঁদের সামনে যাঁরা বসে থাকেন তাঁরা জাতীয় পর্যায়ের কোন ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোন অবদানও তাঁদের নেই। বরং তাঁরা প্রজাতন্ত্রের সেবক অথবা কর্মচারী। এমন বিসদৃশ্য ব্যাপার উপমহাদেশ ছাড়া কোথাও দেখা যাবে না। রাষ্ট্রের যাঁরা সর্বোচ্চ উপাধিধারী তাঁদেরও কোন স্থান নেই কোন সরকারী অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশে কোন বিদেশী অতিথি এলেন। রাষ্ট্রীয় ভোজসভা। গত দুই বছর আগে পর্যন্ত লক্ষ্য করেছি সেখানে মন্ত্রী এবং সামরিক বেসামরিক আমলাদের ভিড়। কোন জাতীয় ব্যক্তিত্বের স্থান নেই। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ উপাধিধারী বা বীরউত্তম, বীরবিক্রমের কোন স্থান নেই। এটি শাসকদের ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন বা দীনতারই প্রকাশ। একটি রাষ্ট্র গর্ব করতে পারে তার আমলাদের জন্য নয়, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের জন্য। রাষ্ট্রের একজন কর্ণধার গর্ব করতে পারেন যখন তার সঙ্গে ঐ জাতীয় ব্যক্তিত্বসমূহের যোগাযোগ থাকে। সেই যোগাযোগ না থাকলে রাষ্ট্রের কর্ণধার ও প্রধান সচিবের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। অবশ্য গত দু’বছরে দেখেছি হয়ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেই ধারার খানিকটা বদল হয়েছে। শিল্পীদের ব্যাপারেও একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি। তাদের প্রদর্শনীতে দেখা যায়, প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বিদেশী রাষ্ট্রের দূত যাঁর সঙ্গে প্রদর্শনীর বিষয়ে কোন যোগ নেই। এর মাজেজা কী? শুনেছি, দূতাবাসের শ্বেতাঙ্গরা যদি দাম দিয়ে দু’একটি ছবি কেনে তাহলে তাঁদের আশা পূর্ণ হয়। কিন্তু সেখানে তাঁর কোন শিক্ষক বা প্রথিতযশা কোন শিল্পীর স্থান নেই। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই হয়। প্রকাশকদের একটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী ও আমার যাওয়ার কথা। কিন্তু পরে জানা গেল, সংস্কৃতি সচিবের এবং অর্থ সচিবের স্থান যদি না হয় তা হলে বই বিক্রির অসুবিধা হতে পারে। এটি জেনে, আমি জানাই আমার পক্ষে অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হবে না। প্রকাশক সমিতি স্বস্তি পায়। কিন্তু সচিবদ্বয় তাঁদের একটি বই বিক্রিতেও সহায়তা দেয়নি। সংস্কৃতিমনা প্রকাশকরা হতে চান না স্বাভাবিকভাবে, হতে চান অর্থবান। (চলবে)
×