ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

মুক্তিযুদ্ধের অন্য রণাঙ্গনের সৈনিক

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২০ মার্চ ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের অন্য রণাঙ্গনের সৈনিক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসেবে অনেক ব্যক্তিত্বই আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। মনে প্রাণে তাঁরাও চেয়েছিলেন বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের গণহত্যা বন্ধ হোক এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই নিক। সকল শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে তাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন। সাহায্যের সবটুকু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের সেই ঋণ অপরিশোধ্য। তবুও জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে যাঁরা, সেই সব বীর ব্যক্তিত্বদের ক্রমান্বয়ে সম্মাননা জানিয়ে আসছেন। এঁদেরই একজন ড. ত্রিগুণা সেন। স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পর পেছনে ফিরে তাকালে তার সেই অবদানকে অতুলনীয় এবং প্রবল সহায়ক বলে মনে হয়। পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন তিনি। মুক্তির সোপান খুলে দিতে নেপথ্যচারী তিনি শ্রমে কর্মে চিন্তা-চেতনায় পরিকল্পনায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সংগ্রামী জাতির স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রেখে দেশোদ্ধারে সর্বাত্মক সহায়তায় তিনি ছিলেন প্রাগ্রসরদের একজন। গোপনে কী পরিমাণ সাহায্য ও সহায়তা করেছিলেন, তা জানা নেই অনেকের। জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গের সিলেটে, ১৯১১ সালে। স্বদেশী আন্দোলনের জন্য জেলও খেটেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। উপাচার্যও ছিলেন। কলকাতা শহরের মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন। আর রাজনীতি ছিল তাঁর অস্থিমজ্জায়। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের শিল্পমন্ত্রী ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রীও ছিলেন। এইসব ছাপিয়ে তাঁকে পাওয়া যায় বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামে সেই পঁয়ষট্টি সাল থেকেই। ‘আজাদ পূর্ব পাকিস্তান’ বেতার কেন্দ্র চালু করে পূর্ববঙ্গের জনগণের আলাদা রাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন- সেসব প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। আর একাত্তর সালে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনের সহায়তার নেপথ্য কুশলী ছিলেন তিনি। তিনি ড. ত্রিগুণা সেন, ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরম সুহৃদ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি ও মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের চীফ সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুসের শিক্ষক। কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ড. ত্রিগুণা সেনের পরিচয় হয়েছিল চল্লিশের দশকে। পরবর্তীতে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য যে নেপথ্য তৎপরতা ছিল, তাতে ভারত সরকারের পক্ষেও লিয়াজোঁ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থী ক্যাম্প, ইয়ুথ ক্যাম্প, বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের আর্থিক সহায়তার নেপথ্যেও ছিলেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে সীমান্ত এলাকায় শরণার্থী শিবিরগুলোও পরিদর্শন করেছেন এবং কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী সরকারী সাহায্য-সহযোগিতার কাজ তিনিই করিয়েছিলেন। সমকালে ছাত্র ও শিক্ষক সমাজে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিক্ষক এবং সংগঠন দুই ক্ষেত্রেই ছিলেন পারদর্শী, কুশলী, স্থিতধি, প্রজ্ঞাবান। নিরলস কাজ করেছেন আলোকবর্তিকা প্রজ্বলনের জন্য। ব্রতচারী আন্দোলনের পথিকৃৎ গুরুসদয় দত্তের ভাগ্নে ত্রিগুণা সেন ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় পৌঁছে সরাসরি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে ড. সেনকে আলিঙ্গন করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘ড. সেন আমি জানি আপনি আমাদের জন্যে কী করেছেন।’ ত্রিগুণা সেন স্বভাবজাত বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, ‘না না, যা করার কিছুই করতে পারিনি।’ বঙ্গবন্ধু সরকারের কেবিনেট সচিব রুহুল কুদ্দুস বঙ্গবন্ধুকে পূর্বেই ড. সেনের মুক্তিযুদ্ধকালীন তৎপরতার কথা জানিয়েছিলেন। তিনিই ড. সেনকে বঙ্গভবনে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ড. সেন এক ঘণ্টারও বেশি আলাপ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন নিয়েও কথা বলেন। এ সময় সিলেটের আরেক কৃতী সন্তান রবীন্দ্র স্নেহধন্য সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের কথা ভাবছিলেন, সে সময় ড. ত্রিগুণা সেন ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর। ১৯৬১ সালে যখন আসামের কাছাড়ে ভাষা আন্দোলন হয়, তখন তিনি শিলচরে ছিলেন। সে সময় পূর্ববঙ্গের বাঙালীদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ঘটে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবরাখবরও পেতেন। লন্ডনে ছাত্র রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে দেখা হয়েছে ষাটের দশকে। পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা যে প্রয়োজন এবং তাদের আলাদা রাষ্ট্র গড়ে তোলা অবশ্য কর্তব্য বলে ত্রিগুণা সেন মতামত দিতেন। আর এই গঠনে ভারতের নেহরু“সরকারকে প্রভাবিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে আগরতলা গিয়েছিলেন। এই ত্রিপুরা থেকেই ড. ত্রিগুণা সেন রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগরতলার গোপন সফরের পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে একটি সহায়ক শক্তি গড়ে তোলা হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সময় মামা গুরু সদয় দত্তের ব্রতচারী চর্চা তাঁর মনবলকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৩২ সালে জার্মানি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নিয়ে আসার পর পুলিশী নজরে পড়েন। সিলেটে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর বিহারে চলে যান। সেখানে গ্রেফতার হওয়ার পর মাসকয়েক জেল খাটেন। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আবার স্বদেশী আন্দোলনে মগ্ন হয়ে পড়েন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ড. ত্রিগুণা সেন এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ‘প্রোপাগান্ডামূলক’ প্রচারণা হলেও তিনি কৌশল নিয়েছিলেন ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে ‘আজাদ পূর্ব পাকিস্তান বেতার কেন্দ্র’ এবং ‘আজাদ বাংলা বেতার কেন্দ্র’ চালু করেছিলেন। যার মধ্যমণি ছিলেন তিনি। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতেন স্নেহাংশুকান্ত আচার্য, পান্নালাল দাশগুপ্ত, অমিতাভ চৌধুরী, মনুভাই ভিমানি ও হেমচন্দ্র গুহ। শেষোক্তজন পরবর্তীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৭ দিন স্থায়ী যুদ্ধের ১৫ দিন ধরে বেতার কেন্দ্র দুটি চালু ছিল। প্রায় একই অনুষ্ঠান প্রচার হতো। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনেই মূলত যুদ্ধ হয়। ভারত ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ হামলা চালায়নি। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ২৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বন্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুদ্ধশেষে এক বিবৃতিতে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে ১৭ দিনের যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেয়ার মতো অস্ত্র বা সেনাবল কিছুই পূর্ববাংলার ছিল না।” যুদ্ধ শেষের মাস চারেক পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ৬ দফা, বাঙালীর মুক্তিসনদ। তারও আগে পাক-ভারত যুদ্ধকালে মুক্তিকামী বাঙালীর সুহৃদ ড. ত্রিগুণা সেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা রাষ্ট্র চাই- স্বাধীনতা চাই’- মর্মে অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ত্রিগুণা সেনের কক্ষেই পরিকল্পনা হতো অনুষ্ঠানের। এতে পূর্ববঙ্গের দেশত্যাগী শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরাই অংশ নিতেন। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের পল্লীগানও বাজানো হতো। পূর্ববঙ্গের মানুষ যে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তানী উপনিবেশে পরিণত হয়েছে, অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে- সেসব তুলে ধরা হতো অনুষ্ঠানে। কলকাতায় অনুষ্ঠান রেকর্ড করার পর মনুভাই ভিমানি সুন্দরবনে লুকিয়ে লঞ্চে গিয়ে খুলনা সীমান্তের বয়রার কাছে এবং আসামের করিমগঞ্জে অপর একজন ‘টেপ’ নিয়ে যেত। আসামের আজাদ বাংলা বেতার কেন্দ্র ও খুলনা সীমান্তের আজাদ পূর্ব পাকিস্তান বেতার কেন্দ্র থেকে পৃথক ঘোষকের কণ্ঠে অনুষ্ঠান হতো। ঘোষণার কাজটি স্নেহাংশু আচার্য ও মনুভাই ভিমানি করতেন। এই দুটো স্থানে ট্রান্সমিটার স্থাপন ও অনুষ্ঠান প্রচারের পুরো পরিকল্পনাই ছিল ড. ত্রিগুণা সেনের। আনন্দবাজারের সে সময়ের বার্তা সম্পাদক শান্তিনিকেতনের কৃতী ছাত্র সিলেটের অমিতাভ চৌধুরী গোটাপাঁচেক কথিকা পাঠ করেছিলেন বাঙালীর স্বাধীনতা কেন প্রয়োজন নিয়ে। এ নিয়ে তিনি লিখেছেনও। আজাদ বাংলা ও আজাদ পূর্ব পাকিস্তান বেতার কেন্দ্র চালুর অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন নেপথ্য থেকে। খুলনার সীমান্ত, আগরতলা বা করিমগঞ্জে বেতার কেন্দ্র চালু করা যায় কিনা তা সরজমিনে পরিদর্শন শেষে ড. ত্রিগুণা সেন মুজিবনগরে শক্তিশালী ট্রান্সমিটার স্থাপনের পদক্ষেপ নেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র পাকবাহিনীর বিমান আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা একটি ট্রান্সমিটার জীপে করে কোনভাবে সরিয়ে নেয়। পরে আগরতলার কাছে কর্নেল চৌমোহনীতে তা স্থাপন করা হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। কিন্তু তার পরিধি ছিল কুমিল্লার সীমান্ত এলাকা ও নোয়াখালী এবং সিলেটের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা ও রামগড়। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার হলেও সীমিত শ্রোতাগ-ি ছিল। ড. ত্রিগুণা সেন স্বাধীনতাকামী বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের বেতার কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে তিনি আগরতলা যান মে মাসের প্রথমে। শরণার্থী শিবির, ইয়ুথ ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। ড. আনিসুজ্জামান তখন আগরতলায়। ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থে ড. ত্রিগুণা সেন সম্পর্কে লিখেছেন, “সমষ্টিগতভাবে আমাদের কী প্রয়োজন, তা পরিমাপ করতে এলেন ড. ত্রিগুণা সেন- বিখ্যাত শিক্ষাবিদ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে তিনি এসেছেন- তখনকার মতো এটাই তাঁর প্রধান দায়িত্ব। শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের পর তাঁর সঙ্গে বিশেষ একটা বৈঠক হলো আমাদের কয়েকজনের। সেখানে আমাদের সরকারের পক্ষে ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমএনএ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এমপি ও মাহবুবুল আলম চাষী সিএসপি, নাগরিক সমাজের পক্ষে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল শরণার্থী শিক্ষক এবং ত্রিপুরার কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহ। বৈঠকে শরণার্থী শিবির ও যুব শিবিরগুলোর ব্যবস্থাপনার কথা, আলোচিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র সজোরে চালু করার বিষয়টি। আমাদের অনুরোধ মতো, একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার দেয়ার সুপারিশ করবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে, সে প্রতিশ্রুতি দিলেন ড. সেন।” এর পর ড. সেন করিমগঞ্জ গিয়েছিলেন। সেখানে ‘আজাদ বাংলা বেতার কেন্দ্র’- এর মতো কেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা বাতিল করেন সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে। কলকাতায় ফিরে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট সচিব রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে আলোচনা করে ৫০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার স্থাপনের পরিকল্পনা নেন। একাত্তর সালের ২৩ মে ট্রান্সমিটারটি স্থাপন করা হয় গোপনস্থানে। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, রেকর্ডিং সবই হতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একটি কক্ষে। পুরো অনুষ্ঠানের টেপ একটি ব্রিফকেসে বহন করে বার্তাদূত নিয়ে যেতেন সম্প্রচার কেন্দ্রে। সেখান থেকেই অনুষ্ঠান প্রচার হতো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের পাশের রুমই ছিল রেকর্ডিং স্টুডিও। গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা। ২৫ মে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র স্বয়ংসম্পূর্ণ রেডিও স্টেশন হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের এটি ছিল তৃতীয় পর্যায়। প্রতিদিন তিনটি অধিবেশন হতো তিন বেলা। এই বেতারকেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে আর্থিক সহায়তার কাজটি করেছিলেন ড. ত্রিগুণা সেন। তারই পরিকল্পনায় একাত্তরের জুন মাসে ‘পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য’ আলাদা প্রচার তরঙ্গ চালু করে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র। এটি করা হয়েছিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলের শ্রোতাদের জন্য। বাংলাদেশের পক্ষে অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো এই কেন্দ্র থেকে। ড. ত্রিগুণা সেন মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশনার ব্যাপারেও আর্থিক সহায়তার যোগান দিয়েছেন। ড. ত্রিগুণা সেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা, প্রচার-প্রচারণা, শরণার্থী শিক্ষকদের কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কারণে সংগঠিত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। বিক্রমপুরের অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দৌহিত্রী ও সরোজনী নাইডুর কন্যা, পশ্চিমবঙ্গের এককালীন গভর্নর পদ্মজা নাইডুর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবী এবং গৌরী আইয়ুব সাম্প্রদায়িক মৈত্রী সমিতি এবং শরণার্থী দুস্থ শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শিশুভবন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্টজনের নেতৃত্বে আরও সংগঠন গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশের পক্ষে। শরণার্থী শিক্ষকরা গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, আর্কাইভস ও তথ্য ব্যাংক। বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব দ্য ইনটেলিজেনশিয়া, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম- এসব সংগঠনের দু’য়েকটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পুস্তিকা প্রকাশ করে তা বিলিও করেছিল। বিদেশেও পাঠানো হয়েছিল। শরণার্থী শিক্ষকদের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সহায়ক সমিতি গঠিত হয়েছিল। ত্রিগুণা সেন এই সংগঠনের জন্য আর্থিক যোগানও দিয়েছিলেন। চল্লিশের দশকে ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ড. ত্রিগুণা সেনের পরিচয়। ড. সেন তখন রিপন কলেজে অধ্যাপনা করতেন। পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বাহাত্তর সালে রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে যখন বঙ্গভবনে পৌঁছেন ড. ত্রিগুণা সেন আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন। নিজের শ্রম ও স্বপ্ন সফল হয়েছে- এই বড় প্রাপ্তি ছিল তার। বঙ্গবন্ধুর আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে সেই সত্যকে উপলব্ধি করলেন, যা তিনি চেয়েছিলেন অর্থাৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মুজিবকে। ড. সেনের সঙ্গে এসেছিলেন মনুভাই ভিমানি। ছিলেন হোটেল পূর্বাণীতে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলিঙ্গনের সেই চিত্র পরদিন সকল সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছেন। সংবাদপত্রে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে ড. সেনকে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়া হয় যখন সেখানে ছাত্র অসন্তোষ চলছিল। ছাত্রদরদী বলে যার নাম ডাক সেই ড. সেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে ফিরিয়ে আনেন শিক্ষার পরিবেশ। এমনই গুণপণা ছিল। সে সুবাদে কিছুদিনের মধ্যে হলেন ইন্দিরা সরকারের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মতান্তর হওয়াতে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেন। সম্পদ তখন তাঁর অল্প টাকার পেনশন। নিজের বাড়িঘর নেই। দু’টি মাত্র কন্যা- বিবাহিতা। অগত্যা চলে গেলেন ‘মা আনন্দময়ীর আশ্রমে’ হরিদ্বারে। টানা ১৬ বছর ছিলেন। সেখানে তাঁর কাজ ছিল সমাগত অতিথিদের জুতো পাহারা দেয়া। মাঝে মাঝে কলকাতায় আসতেন গেরুয়া লুঙ্গি ও গেরুয়া পাঞ্জাবি গায়ে। আনন্দময়ী-মার মৃত্যুর পর চলে আসেন কলকাতায় বড় মেয়ের আশ্রয়ে। তারপর যেন হারিয়ে গেলেন সবকিছু থেকে। ১৯৮৬ সালে কলকাতায় সিলেটবাসীদের পুনর্মিলনীতে বলেছিলেন, ‘আমার একটি মাত্র ব্রত, সকলকে ভালবাসতে হবে’। ভালবেসেছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষকে, যেখানে জন্মেছিলেন। ভালবেসে সেই মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন নেপথ্যে। ইতিহাসের খেরো খাতায় তার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে, বিস্মৃত বাঙালীর মনে পাওয়া না গেলেও।
×