ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

পদের মহিমা ॥ ঔপনিবেশিকোত্তর, ঔপনিবেশিক মন

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৯ মার্চ ২০১৫

পদের মহিমা ॥ ঔপনিবেশিকোত্তর, ঔপনিবেশিক মন

পূর্ববঙ্গের ইংরেজী শিক্ষিতরা পেশা হিসেবে, উনিশ শতকের শুরুতে কী বেছে নিচ্ছিলেন তার খানিকটা পরিচয় পাওয়া যাবে, ঢাকা কলেজের ছাত্ররা কোন্্ কোন্্ পেশা বেছে নিয়েছিলেন তা বিশ্লেষণ করে। এখানে উল্লেখ্য, কলেজের পড়া শেষ করে যে অনেকে চাকরি নিয়েছিলেন তা নয়। ফোর্থ থেকে ফার্স্ট ক্লাস- এই চারটি শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই অনেকে পেশা বেছে নিয়েছিলেন। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ পর্যন্ত এ চার বছরের এক তালিকায় দেখা গেছে, অধিকাংশই (৪৪ জন) নিযুক্ত হয়েছিলেন ছোট-খাটো সরকারী চাকরিতে। এসব চাকরির মধ্যে ছিল কেরানী, সেরেস্তাদার, মুনসেফ, দারোগা (১০ জন) প্রভৃতি। এসব চাকরির বেতন ছিল ৪০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত, তারপরে স্থান ছিল শিক্ষকতার। ১৫ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত বেতনে ৩৬ জন নিযুক্ত হয়েছিলেন বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী স্কুলে। আইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন চৌদ্দ জন। ১ জন হয়েছিলেন এ্যাকাউনটেন্ট। চারজন কলেজ পাস করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন এবং এদের মধ্যে একজন ছিলেন অন্নদাচরণ খাস্তাগীর, যিনি পরে পূর্ববঙ্গের এক প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর, জমি-জমা সংক্রান্ত জটিলতাই আইন ব্যবসায়ের পথ খুলে দিয়েছিল। যারা আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন, বলা যেতে পারে পরোক্ষভাবে তারাও জমির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ক্রমে এ পেশা লাভজনক এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ১৮৬৪-৭৩-এ ক’বছরে কলকাতা থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রী নিয়েছিলেন ৭০৪ জন। ১৮৮১ সালের এক হিসাবে জানা যায় শুধু পুরো বাংলা প্রদেশেই ৫.১৮ কোটি টাকার (সম্পূর্ণ ভারতের ১/৩ মামলা) হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসকের আইন যে নিরপেক্ষ এবং তা গরিবের রক্ষক এ বিষয়ে মধ্য শ্রেণী নিশ্চিত ছিলেন উনিশ শতকে। তাই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিসের আইনের অধস্তন রক্ষক হিসেবে। আইন পাস করে আইনে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে হয়েছিলেন তিনি ব্যারিস্টার, এ্যাডভোকেট, উকিল প্রভৃতি। সভা-সমিতি, সংস্থা, সবকিছু গড়তে এসেছিলেন তারাই উদ্যোগী হয়ে। মফস্বলে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল কোর্ট কাচারী এবং একে আশ্রয় করেই জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন অনেকে। যা হোক এই নতুন মুনসেফ, ডেপুটি, স্কুলে সাবইন্সপেক্টর, উকিল, প্রায় সবাই চাকরিগত কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলেন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন মফস্বল শহরগুলোতে। যেখানে আধা গ্রামীণ আধা নাগরিক সমাজে তারাই হয়ে উঠেছিলেন সমাজের নেতা। স্কুল গড়েছিলেন তারা, সভাসমিতি করেছিলেন, নজর দিয়েছিলেন নিজ নিজ জীবনযাপনের শৃঙ্খলার দিকে। ছুটিতে জমিদারদের মতো তারাও গ্রামের বাড়িতে যেতেন, দান-ধ্যান সালিশ করতেন, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে তারা কৃত্রিম আড়ম্বরের দিকে মন দিয়েছিলেন। বিয়ে, ধর্মীয় উৎসব, পোশাক আশাক সবক্ষেত্রেই তারা ঝুঁকেছিলেন আড়ম্বরের দিকে, তারা যে আলাদা একটি শ্রেণী তার স্বতন্ত্র্য জ্ঞাপনের জন্যে। এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় মধ্যশ্রেণীও তখন পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে জমির ওপর ছিল নির্ভরশীল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাও যুক্ত ছিল একটি পেশার সঙ্গে। আগ্রহী ছিল তারা প্রধানত শিক্ষার প্রতি, কারণ সমাজে হয়ে উঠেছিল তা মর্যাদার প্রতীক এবং মফস্বল শহরগুলোই ছিল তাদের প্রধান আবাসস্থল। মধ্যশ্রেণী বা পেশাজীবী, জমিদারদের মতোই সমাজে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। তার প্রমাণ, ঐ সময় তাদের পরিচালিত পত্র-পত্রিকা। জমিদারদের সঙ্গে যে তাদের সংঘাত ছিল না তা নয়, সামাজিক প্রাধান্য নিয়ে সংঘাত ছিল। বিশেষ করে সভা-সমিতি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নির্বাচন প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে কোনো জমিদার নির্বাচনে দাঁড়ালে পেশাজীবীরা একত্রিত হয়ে তাকে পরাজিত করেছেন। যেমন- ১৮৮৪ সালে ঢাকা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিল আইনজীবী আনন্দচন্দ্র রায়, যদিও ঢাকা শহরে নবাবদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তখন অসামান্য। লোকাল বোর্ড নির্বাচনে জমিদারদের খানিকটা প্রাধান্য থাকলেও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডগুলোতে প্রাধান্য ছিল পেশাজীবী বিশেষ করে আইনজীবীদের। এর কারণ, মফস্বল শহরগুলোতেই আইনজীবীদের ভিড় ছিল বেশি। অন্যদিকে গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ের জমিদারদের প্রতিপত্তি থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। পেশাজীবীদের আচরণ দেখে অনেক সময় আবার মনে হতে পারে যে, তিনি বুঝি সাধারণ মানুষের পক্ষে। অন্তত নীল বিদ্রোহের সময় কৃষকদের পক্ষে মধ্যশ্রেণীর উচ্চকণ্ঠ এর উদাহরণ। রণজিৎ গুহ (১৯৭৪) এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, আসলে নীলকরদের নিপীড়ন মধ্যশ্রণীর উদারনীতিতে আঘাত করেছিল। নীলকরদের ঔদ্ধত্য তার মনে আঘাত হেনেছিল যা তৈরি হয়েছিল পাশ্চাত্যের মানবতাবাদ ও ভারতীয় অভিভাবকদের মিশ্রণে। শহরে বাস করলেও গ্রামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। নীলকররা আঘাত হেনেছিল তার অর্থনৈতিক অবস্থা (গ্রামের মধ্যস্বত্ব বা বর্গা) এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বে (গ্রামীণ এলিটদের সদস্য হিসেবে)। তাই কৃষকদের পক্ষে সে দাঁড়াতে চেয়েছিল নিজেকে সমর্থনের জন্যে। নীলকরের বিরুদ্ধে রায়ত অস্ত্র তুলে নিলে তার আপত্তি নেই কিন্তু সে নিজে অস্ত্র তুলে নেবে না, কারণ তা হলে তা হবে নীলকরদের মতো বেআইনী। সুতরাং এই নিপীড়ন বন্ধ করতে পারে একমাত্র আইন। আইনের রক্ষক সরকার এবং তা প্রমাণ করতে পারে সরকারই। সুতরাং কুসংস্কারের দেশে, উদারনীতির নতুন ধর্ম আরেক ধরনের কুসংস্কারের জন্ম দেয় ঔপনিবেশিক মধ্যশ্রেণীর নৈতিকতা, রাজনীতি ও মননে খাপ খাওয়ানোর জন্য। (চলবে)
×