ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুযোগ পেলে ‘গ্রিন গার্মেন্টস’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান

সবার লক্ষ্য গার্মেন্টস খাত ॥ বিদেশী উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশমুখী

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৯ মার্চ ২০১৫

সবার লক্ষ্য গার্মেন্টস খাত ॥ বিদেশী উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশমুখী

এম শাহজাহান ॥ গার্মেন্টস খাতে বিনিয়োগ করতে বিদেশী উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশমুখী। সবার লক্ষ্য তৈরি পোশাক খাত। দেশের গর্ব পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে চান তাঁরা। চীন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, জার্মানি, ডেনমার্ক এবং কানাডার উদ্যোক্তারা এখন ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে ‘গ্রিন গার্মেন্টস’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন বিদেশী উদ্যোক্তারা। এই পরিকল্পনার আওতায় সরকারের কাছে শতভাগ পরিবেশবান্ধব গার্মেন্টস কারখানা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগের অনুমতি পেতে ছুটছেন বিনিয়োগ বোর্ড এবং রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র কাছে। সরকারী বিভিন্ন দফতরেও ছুটে বেড়াচ্ছেন বিদেশী উদ্যোক্তারা। তবে পোশাক শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগে প্রবল আপত্তি রয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। তাঁরা বলছেন, বেসিক গার্মেন্টসে বিদেশী বিনিয়োগ হলে দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাড়বে চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে এই শিল্প হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাও তাঁদের। তাই বেসিক গার্মেন্টস খাতে বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি না দিতে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। তবে শর্তসাপেক্ষে এ শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, সব বাধা পেরিয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে দেশের গার্মেন্টস খাত। দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি এই শিল্পে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদেশী বিনিয়োগ। সস্তা শ্রম এবং ইউরোপের বাজারে শুল্ক সুবিধার সুযোগ নিতে বিদেশী গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরাও এদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি বাতিল, রানা প্লাজা ধস এবং তাজরীনে অগ্নিকা-ের মতো আলোচিত ঘটনায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও এর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি পোশাক শিল্পের বিনিয়োগে। বরং ক্রেতাদেশগুলোর বিভিন্ন শর্তারোপের কারণে গত কয়েক বছরে কমপ্লায়েন্ট কারখানা গড়ে তুলতে কাজ করছে উদ্যোক্তারা। যদিও বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য পরিবেশবান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠা করে গ্রিন গার্মেন্টস যুগে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন আগে থেকেই। কিন্তু এ ধরনের গার্মেন্টস কারখানা গড়ে তুলতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন সেটা তাদের নেই। এই সুযোগ নিতে বিশ্বমানের গার্মেন্টস পণ্য তৈরিতে ইতোমধ্যে দেশে ৩৫-৪০টি গ্রিন গার্মেন্টস কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী ওয়ারেছী জনকণ্ঠকে বলেন, গার্মেন্টস শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে বিদেশী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে চীন, জাপান, ভারত, জার্মানি, ডেনমার্ক এবং কানাডার উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন। ইপিজেডগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। তবে তারা এখন ইপিজেডের বাইরেও বেসিক গার্মেন্টসে বিনিয়োগ করতে চান। এজন্য পরিবেশবান্ধব গ্রিন গার্মেন্টস গড়ার প্রস্তাব রয়েছে তাদের। তিনি বলেন, বেসিক গার্মেন্টস বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র তীব্র আপত্তি রয়েছে। তারা বলছেন, এ জাতীয় গার্মেন্টসে বিদেশী বিনিয়োগ হলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা চাপের মুখে পড়বেন। তাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, বিজিএমইএ’র এই দাবি বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। তবে এ শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ নিরৎসাহিত করা হচ্ছে না। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে। এই বাস্তবতায় যেসব বিদেশীর আবেদন অপেক্ষমাণ তাদেরকে দ্রুত অনুমতি দেয়ার জন্য বিজিএমইএকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে নতুন আবেদন পড়লে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, গার্মেন্টস খাতে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে কি করা যায় তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও বৈঠক করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখানে কোন বাধা নেই। বাংলাদেশের মতো এমন মুক্তনীতি পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। শতকরা এক শ’ ভাগ বিদেশী মালিকানায় ব্যবসা করার অনুমতি রয়েছে এ দেশে। তবে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয় মালিকদের স্বার্থ বিবেচনা করছে সরকার। বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার গার্মেন্টস রয়েছে। আর এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা। যে কারণে বিদেশী বিনিয়োগে আপত্তি ॥ বেসিক গার্মেন্টসে বিদেশী বিনিয়োগ হলে দেশীয় উদ্যোক্তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে তৈরি পোশাক খাতে বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তাঁদের অভিযোগ, বিদেশী উদ্যোক্তাদের কারখানায় দেশের শ্রমনীতি অনুসরণ করে বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। কারখানা স্থাপনের প্রথম দিকে তারা বেশি বেতনে শ্রমিক নিয়োগ দিলেও পরে বেতন কমিয়ে দেন। এ ছাড়া ওসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটলে সেই অসন্তোষ নিরসনে বিদেশীরা দায় নিতে চান না। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের এসব তথ্য তুলে ধরে তাদের বিশেষ সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে এসব আপত্তি জানান বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর প্রতিনিধিরা। এছাড়া দেশের তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ-এর সদস্য হতে চাইছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) সুবিধাও চেয়ে আসছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য উন্নত দেশগুলোতে রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি (বিশেষ শুল্ক সুবিধা) পায়। এই সুবিধা নিতে পণ্যটি যে বাংলাদেশে তৈরি সে জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ইউডি সার্টিফিকেট নিতে হয়। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্যই সরকারের কাছে ‘ইউডি’ সুবিধা দাবি করে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সহসভাপতি রিয়াজ-বিন-মাহমুদ সুমন জনকণ্ঠকে বলেন, বেসিক গার্মেন্টস খাতে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন নেই। বিদেশীরা টেক্সটাইল এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন। তিনি বলেন, বেসিক গার্মেন্টসে বিদেশী বিনিয়োগ এলে দেশীয় উদ্যোক্তারা তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবেন। তাই দেশীয় উদ্যোক্তাদের রক্ষায় এ শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এলডিসি দেশ হিসেবে পোশাক রফতানিতে আমরা বিশেষ কোটা ও শুল্ক সুবিধা পেয়ে থাকি। কিন্তু বিদেশীদের একই সুবিধা দেয়া হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া ডেনমার্ক ও কানাডা দেশের বেসিক গার্মেন্টস খাতে বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। এই দুটি পোশাক শিল্পে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। দেশ দুটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গ্রিন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করে এদেশে বিশ্বমানের পোশাক তৈরি করা হবে। ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শর্তসাপেক্ষে বিদেশী বিনিয়োগ হতে পারে ॥ পোশাক শিল্পে শর্তসাপেক্ষে বিদেশী বিনিয়োগ হতে পারে বলে মনে করছে সরকার। এ কারণে দেশীয় উদ্যোক্তাদের আপত্তির মুখেও সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয়েছে, যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে গার্মেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ করেছে এবং যারা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয় কিন্তু সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছে তাদের ইউডি সুবিধা দেয়া যাবে। সম্প্রতি এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বিজিএমইএ কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
×