ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুপ্রীমকোর্ট বারের নির্বাচন ॥ সাদা প্যানেল যেভাবে হারল

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৮ মার্চ ২০১৫

সুপ্রীমকোর্ট বারের নির্বাচন ॥ সাদা প্যানেল যেভাবে হারল

আরাফাত মুন্না ॥ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের কাছে টানা তৃতীয়বারের মতো পরাজিত হয়েছেন সরকার সমর্থকরা। গত দুবার পরাজয়ের নেপথ্যে শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও এবার নতুন যোগ হয়েছে প্রতিশোধ। অভিযোগ রয়েছে, গত দুবার পরাজিতরা এবার প্রতিশোধ নিয়েছেন। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার সময় সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, তা রক্ষা করেননি অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাই। অভিযোগে আছে, তারা শুধু সমাবেশ ও র‌্যালিতে অংশ নিয়েই দায় সেরেছেন। প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষে তাদের ভোট চাইতে দেখা যায়নি। তবে প্রার্থী নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে এবার সরকার সমর্থকরা পাঁচটি পদ পেয়েছেন বলেও মনে করছেন অনেকে। রাতে ভোট গণনার সময় ১৩০টিরও বেশি ব্যালটে দেখা গেছে অন্য রকম ঘটনা। ওইসব ব্যালটে সভাপতি পদে খন্দকার মাহাবুব হোসেনকে ভোট দেয়া হলেও বাকি ভোটগুলো ছিল সরকার সমর্থক প্যানেলে। অথচ সরকার সমর্থক সভাপতি প্রার্থী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন পরাজিত হয়েছেন মাত্র ১৭৯ ভোটের ব্যবধানে। অনেক ব্যালটে আবার সম্পাদক পদে ভোট দেয়ার স্থানে লেখা ছিল নানা ধরনের মন্তব্য। ওই ব্যালটগুলোরও বাকি ভোট ছিল সরকার সমর্থক প্যানেলেই। এদিকে রাতে ভোট গণনার সময় সরকার সমর্থক জোটের জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। সরকার সমর্থক আইনজীবীদের অভিযোগ ও জনকণ্ঠের পর্যবেক্ষণে সরকার সমর্থক আইনজীবীদের পাঁচটি সংগঠনের জোট সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের টানা পরাজয়ের নেপথ্যে এসব কারণ উঠে এসেছে। একাধিক সূত্র জানায়, গণভবনে আইনজীবীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সব কিছু বিবেচনা করে সুপ্রীমকোর্ট বারের এবারের নির্বাচনে সরকার সমর্থক প্যানেল ঠিক করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় নিজেদের প্যানেলকে জয়ী করতে সমন্বয় পরিষদের নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তখন সমন্বয় পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেও বিগত দিনে পরাজয়ের ক্ষোভ ও অভিমান ভেতরে ভেতরে চাপা প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনী মাঠে। সূত্র জানায়, বিগত বার কাউন্সিল নির্বাচন থেকে সরকার সমর্থক পাঁচটি সংগঠনের জোট সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মধ্যে বিভেদের সূত্রপাত ঘটে। ওই নির্বাচনে সমন্বয় পরিষদের প্যানেলের প্রার্থীরা ২৮টি আইনজীবী সমিতিতে নির্বাচনী প্রচার শেষ করার পর সমন্বয় পরিষদের তৎকালীন সদস্য সচিব সুব্রত চৌধুরী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে নির্বাচন স্থগিত করে দেন। পরে নতুন তফসিল ঘোষণার পর সমন্বয় পরিষদ থেকে ঘোষিত প্রথম প্যানেলের অধিকাংশ প্রার্থীকেই বাদ দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে পূর্ব ঘোষিত প্যানেলের বাকি প্রার্থীরাও তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। সেখান থেকেই শুরু হয় সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের বিভাজন। অভিযোগ রয়েছে, ওই নির্বাচনে আব্দুল বাসেত মজমুদারসহ তার অনুসারী কয়েক আইনজীবী নেতা সমন্বয় পরিষদের প্যানেলের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং প্যানেলের প্রার্থীদের ভোট দিতেও অনেককে নিষেধ করেন। সেখান থেকে সমন্বয় পরিষদের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেন। অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা। এরপর এক আইনজীবী প্রতিনিধি সমাবেশে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আব্দুল বাসেত মজুমদারের তীব্র সমালোচনা করা হয়। ওই সমাবেশে বাসেত মজুমদারদের যুদ্ধাপরাধীদের দোসর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে সরাসরি বিভক্ত হয়ে যায় সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ। পরে আব্দুল বাসেত মজুমদারকে আহ্বায়ক করে সমন্বয় পরিষদের একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর সুপ্রীমকোর্ট বারের ২০১৩-১৪ সালের নির্বাচনে আব্দুল বাসেত মজুমদার ও রবিউল আলম বুদু নেতৃত্বাধীন প্যানেলের ভড়াডুবি হয়। পরে ২০১৪-১৫ মেয়াদের নির্বাচনে শুধু নিজেদের কোন্দলের মীমাংসা না হওয়ায় ভড়াডুবি হয় আব্দুল মতিন খসরু-রবিউল আলম বুদু প্যানেল। ২০১৪-১৫ মেয়াদে পরাজয়ের জন্য এবারের সম্পাদক প্রার্থী মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদীর বিরুদ্ধে বিশ্বাস ঘাতকতার অভিযোগ তোলেন অনেকে। সরকার সমর্থক একাধিক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, গত দুবার নির্বাচনের নিজেদের কোন্দলের কারণে বড় ধরনের পরাজয় মেনে নিতে হয় সমন্বয় পরিষদকে। এ কোন্দল চূড়ান্তভাবে মীমাংসা না হওয়ায় এবারও জয় দেখা সম্ভব হলো না সমন্বয় পরিষদের। তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের উচ্চমহলের পক্ষে সমন্বয় পরিষদের দুটি অংশকে একত্রিত করা সম্ভব হয়নি। সমন্বয় পরিষদের দুটি অংশকে একত্রিত না করতে পারলে কোনদিন বারের ক্ষমতায় আসা সম্ভব হবে না। নির্বাচনের ফলাফল সরকার সমর্থকদের পরাজয়ের কারণে টানা তৃতীয়বারের মতো সুপ্রীমকোর্ট বারের নেতৃত্বে থাকছে বিএনপি জামায়াত সমর্থক জোট। গত দুইবারের তুলনায় এবার পদ সংখ্যা কমলেও শীর্ষ দুটিসহ নয়টি পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের (নীল প্যানেল) প্রার্থীরা। অন্যদিকে একজন সহ-সভাপতি ও একজন সহ-সম্পাদকসহ পাঁচটি পদে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ। গত রবি ও সোমবার টানা দুই দিন ভোট গ্রহণের পর গণনা শেষে মঙ্গলবার ভোরে নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির প্রধান মোঃ হারুন অর রশিদ ফলাফল ঘোষণা করেন। ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন এক হাজার ৮০৬ ভোট পেয়ে নীল প্যানেল থেকে সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের প্রার্থী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন পেয়েছেন এক হাজার ৬২৭ ভোট। সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন এক হাজার ৯৩৭ ভোট পেয়ে নীল প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এ পদে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদি পেয়েছেন এক হাজার ৫২৯ ভোট। সহ-সভাপতি ও সহ-সম্পাদকের দুটি করে পদে দুই প্যানেল থেকেই একজন করে নির্বাচিত হয়েছেন। সরকার সমর্থকদের সমন্বয় পরিষদের প্যানেল থেকে আবুল খায়ের সহ-সভাপতি পদে এক হাজার ৭১১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। আর বিএনপি সমর্থক প্রার্থী এএসএম মোক্তার কবির খান এক ৬৯৬ ভোট পেয়ে অপর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সহসম্পাদক পদে সরকার সমর্থক মোঃ দেলোয়ার মোস্তফা চৌধুরী (মধু) ১৬৪৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। সমিতির এই পদে আরেকজন এসেছেন জাতীয়তাবাদী প্যানেল থেকে- মাজেদুল ইসলাম পাটওয়ারী উজ্জ্বল ১,৮০৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয়তাবাদী প্যানেলের প্রার্থী শওকত আরা বেগম দুলালী এক হাজার ৮৫২ ভোট পেয়ে কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। সদস্য পদে বিএনপি-জামায়াত জোট সমর্থকদের প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন শামীমা সুলতানা দীপ্তি (২০৪৯), আনোয়ারুল ইসলাম শাহিন (১৮৩৯), মির্জা আল মাহমুদ (১৭৬৫) ও মোঃ জসিম সরকার (১৬৩৮)। সমন্বয় পরিষদের প্যানেল থেকে মহিউদ্দিন শামীম (১৭৭৩), একেএম দাউদুর রহমান মিনা (১৬৮৯), অমিত দাশগুপ্ত (১৬৮৩) ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। গত দুটি নির্বাচনেই সমিতির ১৪টি পদের মধ্যে ১৩টিতে জয়ী হয় বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা। তার আগের নির্বাচনে সরকার সমর্থকরা সম্পাদকসহ বেশিরভাগ পদে জয়ী হয়েছিলেন। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৫-১৬ মেয়াদের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ৪ হাজার ৩শ’ ৫৭ জন সদস্য। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫২৯ জন ভোটারই ভোট দিয়েছেন।
×