ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ পরাজিতদের উল্লাস

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৮ মার্চ ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ পরাজিতদের উল্লাস

নিজেদের শক্তি ও সাহসে ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে স্বপ্ন পূরণ করেছে বাংলাদেশ। অধিনায়ক মাশরাফি যখন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করলেন, বিজয় উৎসর্গ করলেন, আমার মতো অনেকের বুকের তলা সজল হয়ে উঠেছিল। অধিনায়কের কথা তো ভিন্ন, আমার এক অনুজ বন্ধু লিখেছে, এ্যাডিলেডের মাঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গীত হওয়ার কালে দেশ থেকে বেড়াতে আসা তার মা অঝরধারায় কাঁদছিলেন। যে দেশের জাতীয় সঙ্গীতে ‘বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’ লেখা আছে তার মানুুষ তো কাঁদবেই। এই কান্না-হাসি, আনন্দ-বেদনাও উৎকণ্ঠার ধারক। এটাই আমাদের সঙ্গে অন্যদের তফাত। যে দেশের অংশ হয়ে ছিলাম বা এখনও যার দালালি করার কারণে এক শ্রেণীর বাঙালী উন্মাদ তাদের জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি, আমাদের গানে কোথাও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হুঙ্কার নেই। পাক জমিন না নাপাক জমিন, তার চেয়ে বড় ব্যাপার ভালবাসা। জয় উন্মাদনা ও ভালবাসা এক বিষয় নয়। নয় বলেই ঘোমটা টানা বঙ্গনারী আমার মা, হিজাব পরিহিতা আমার ভগ্নিদের চোখে জল। পোশাকে যে সাম্প্রদায়িকতা নেই এবং তা জামায়াতীদের সমর্থন প্রমাণ করে না, সেটাই তুলে ধরেছেন এরা। বাংলাদেশের ক্রিকেট জয়ের ভেতর দিয়ে সম্ভাবনার যে দুয়ার খুলেছে তার একটা দিক উপেক্ষিত হলে চলবে না। সে দিকটা পছন্দ না হলেও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। দেশের জয় মানে দেশবাসী ও প্রবাসী সব বাংলাদেশীর জয়, কিন্তু যারা এ দেশ মানে না, জন্মলগ্ন থেকে দেশ, মাটি ও মানুষের অকল্যাণ আর সর্বনাশ চেয়ে আসছে, ৪০ বছর পরও বাংলাদেশকে বাংলাস্তান বানানোর জন্য দেশ-বিদেশে চক্রান্ত করছে, এই সব মোনাফেকদের কি আসলেই বিজয় দিন পালনের অধিকার আছে? যে দেশে শান্তি থাকে না, সম্প্রীতি থাকে না, ভালবাসা থাকে না, সে আতঙ্কপুরী ক্রিকেট কেন, কিছুতেই ঝলসে উঠতে পারার কথা নয়। অথচ আমরা এদের মুখে ছাই দিয়ে তা করে দেখিয়ে দেই। ফলে এসব প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন দুশমনদের বিজয় র‌্যালির আদপে কোন মূল্য নেই, এও এক ধরনের প্রতারণা। সবচেয়ে দঃখের ব্যাপার এদের কথা শুনলে মাশরাফি, মুশফিক, রুবেল, সৌম্য বা তামিমের জন্ম হতো না। ধরে নিলাম চাপে পড়ে বা লোক দেখানোর জন্য দলে নিতে বাধ্য হলেও কি এগারোজনকে নিত? না অর্ধেক অর্ধেক ভাগে পাঁচজন পেতাম আমরা? যারা এ হিসাবটা জেনেও দেশের বিরুদ্ধে পাকিদের হয়ে দালালি করে তাদের মুখে যাই থাক অন্তরে বাংলাদেশ নেই। যাদের তা নেই তাদের বিজয় মিছিল করার ব্যাপারটাও হাস্যকর। বাংলাদেশের ক্রিকেট বা যে কোন বিজয় ইতিহাসের পরম্পরায় যুক্ত এক উজ্জ্বলতা। যে তিমির থেকে, অন্ধগর্ভ থেকে আমাদের জন্ম তার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ছায়া আছে সবকিছুতে। দূরদেশে দুনিয়া কাঁপানো ভেন্যুতে বাঙালী বাংলার সগর্ব বিচরণ দেখলেই মনে পড়ে- ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ পাইপ হাতে ব্যাকব্রাশ করা কালো চুলের অনিন্দ্যসুন্দর দীর্ঘকায় বঙ্গবন্ধু যেন আমাদের পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁর দোয়া আছে শুভ কামনা আছে এই জাতির ওপর। এসব যারা মানে না, এ জাতীয় উদার আধুনিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতায় যাদের অনীহা ও বৈরিতা তারা আমাদের জাতীয় স্রোতের বিপরীতে। তাই এদের আনন্দে বা উল্লম্ফনে আমাদের কিছু যায় আসে না। বরং সতর্কতার বিকল্প নেই। এসব মূর্খ দেশদ্রোহী নব্য ও পুরনো রাজাকারের ফলস দেশপ্রেমে কিছু যায় আসে না, তেমনি এরা কিছু নিয়ন্ত্রণও করে না। তাদের ষড়যন্ত্র বা কুরুচি সত্যি নয় বলেই আজ তিন দেশের খেলায় রবীন্দ্রনাথ বেজে ওঠেন, জীবনে তেরোবার বিদেশ ভ্রমণে একবারও আসেননি অস্ট্রেলিয়ায়, বঙ্গবন্ধুও না। অথচ তাঁরাই আজ জীবন্ত মূর্ত। বাংলাদেশ যে এঁদের চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে সেটাই দেখছি আমরা। [email protected]
×