ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদের মহিমা ॥ ঔপনিবেশিকোত্তর, ঔপনিবেশিক মন

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১৮ মার্চ ২০১৫

পদের মহিমা ॥ ঔপনিবেশিকোত্তর, ঔপনিবেশিক মন

পদের যে মহিমা আছে তা নতুন কোন কথা নয়। সমাজ, বিশেষ করে অনুন্নত সমাজের এটি একটি বৈশিষ্ট্য। গণতান্ত্রিক সমাজে পদ আছে। মহিমাও আছে, তবে সমাজে তা বড় কোনো ভূমিকা রাখে না। সাধারণের মানসিক জগতেও, মার্কিন রাষ্ট্রাচারেও সে প্রভাব ফেলেছে। সেনাবাহিনীর একজন মেজর দেখলে আমরা কাতর হই, আর সেখানে তিন বাহিনী প্রধানের স্থান পোস্টমাস্টার জেনারেলের পরে। জেনারেলের পদক্রম ৫৫ নম্বরে। ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে শাসকরা পদের মহিমা প্রচার করতেন বিভিন্নভাবে, যার উল্লেখ আছে বর্তমান গ্রন্থের পূর্ববর্তী কয়েকটি প্রবন্ধে, স্বাধীন দেশে তো তা থাকার কথা ছিল না। অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করি- অসলো শহরের কেন্দ্রে। বাণিজ্যিক এলাকা দেখতে গেছি। এলাকার রাস্তার মাঝামাঝি এক পাশে বিরাট এক সুপার মার্কেট। অন্যদিকে উঁচু মতো টিলা। একটি রাস্তা উঠে গেছে। বেশ ভিড় সেদিন। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে টিলা মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। একটি বা দু’টি মোটর সাইকেলের পেছনে একটি গাড়ি এসে থামল সুপার মার্কেটের সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন এক ভদ্রলোক। আমার বন্ধু বললেন, ঐ যে প্রধানমন্ত্রী। অন্য পাশ দিয়ে নামলেন এক মহিলা। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ঢুকলেন সুপার মার্কেটে, একা। আর স্ত্রী উল্টোদিকের রাস্তা ধরে উঠে আসতে লাগলেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি হিলের শব্দ তুলে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন তার গন্তব্যে। বছর দু’য়েক আগের কথা। চাঁদপুর থেকে ফিরছি। ডেমরার মোড়ে পৌঁছবার আগেই দেখলাম বিশাল লাইন। কেউ কিছু বলতে পারছে না। তখন দুপুর প্রায় দুটো। পোয়া মাইল হেঁটে আমি মোড়ে পৌঁছলাম। পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কী’। ‘প্রেসিডেন্ট আসবেন?’ ‘কোথায় আসবেন?’ ‘ফ্লাইওভার দেখতে।’ ‘তা যখন দেখতে আসবেন তখন রাস্তা বন্ধ করুন।’ কোনো জবাব নেই। আমাকে অবশ্যই ঢাকা পৌঁছতে হবে আধঘণ্টার মধ্যে। আধঘণ্টা ধরে মোড়ের অর্ধেক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা বলেও কোনো ফল হলো না। হেলাল তখন [এখনও] প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব। ফোন করলাম। ফোন ধরলেন। বললাম, ‘প্রেসিডেন্ট কখন আসবেন জানেন? যদি দেরি হয় এখানে বলে দেবেন যাতে আমাদের ছেড়ে দেয়। আর যদি এখনই আসেন তাহলে তো আর কথাই নেই। আমাকে একটু জানাবেন, অপেক্ষা করছি আপনার ফিরতি কলের।’ হেলাল আর ফোন করেননি। প্রয়োজন বোধ করেননি। কারণ তার অবস্থান বঙ্গভবনে, প্রেস সচিব। ৪৫ মিনিটেরও পরে মহামান্য প্রেসিডেন্ট এলেন ফ্লাইওভার পরিদর্শনে। ১০ মিনিট থেকে চলে গেলেন। গাড়ির লাইন তখন মাইল পেরিয়েছে। নিজের গাড়িতে ফিরে যেতে যেতে দেখলাম অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে। সেদিন তাপমাত্রা ছিল বেশি। মহিলারা ঘর্মাক্ত, শিশুরা কাঁদছে এবং গালাগাল। প্রেসিডেন্টের পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান এবং তিনি নিজে কেউ বাদ যাচ্ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট কী এই সব ঘটনা জানেন? হয়ত জানেন, হয়ত জানেন না। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা থাকবেই, বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে বিএনপি-জামায়াতের মতো জঙ্গী দলগুলো আছে। শেখ হাসিনার নিরাপত্তা আরও জরুরী ব্যাপার। কিন্তু, নিরাপত্তা নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা যা করে তা এক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে এবং প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রী ধিক্কৃত হন। তাঁরা বিষয়টি একবারে জানেন না, তা তো নয়। অনেক আগে থেকে নিরাপত্তা ডিটেলের আয়োজন বরং লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের পদের ক্ষমতা ও মহিমার জন্য প্রদর্শনীটা আরও বেশি করে। নিরাপত্তার নামে এই প্রদর্শনী ও গরিমা প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী খানিকটা সংবরণ করতে বলতে পারেন। প্রেসিডেন্ট আসবেন দেখে প্রায় এক ঘণ্টা সবাইকে আটকে রাখতে হবে, এটি সভ্যতার মাপকাঠিতে পড়ে না। আমরা সবাই ভুলে যাই, আমাদের দু’জন প্রেসিডেন্ট, তাঁদের পরিবার, চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষজন, আমজনতার কেউ নন। নিরাপত্তা আসলে সার্বক্ষণিক প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার। তিনি অনেকেরই টার্গেট এবং খালেদা জিয়ারও হয়ত। অন্যদের পদ গেলে দেখি নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় না। আর একবার মজার এক ঘটনা ঘটল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সচিব। তার ওখানে আমাকে আর হাশেম খানকে একটি প্রকল্পের কাজে যেতে হতো। কাজটা আমদের নয়, মন্ত্রণালয়েরই। তা সচিবের ভাবসাব দেখে, আমি বললাম, ‘আপনি আর কতদিন সচিব থাকবেন? তারপর কী হবে? এই করিডর দিয়ে হেঁটে গেলেও তো কেউ আপনাকে চিনবে না।’ এর বেশ কয়েক বছর পর। আমি আর হাশেম খান কাকতালীয়ভাবে কী একটা কাজে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলাম। এক ভদ্রলোক সালাম দিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন, চিনলেন আমাকে?’ আমি আবার দ্রুত চেহারা ও নাম ভুলে যাই। হাশেম খান চিনলেন। বললেন, ‘আরে আপনি অমুক না? সচিব ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের।’ ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন। আমি হাসলাম, বললাম, ‘চলেন এক কাপ চা খাই কোথাও।’ এতই ক্ষণস্থায়ী পদের মহিমা। আসলে অবসর গ্রহণের পর আবার নিজ কর্মস্থলে কখনও গেলে পুরনো সহকর্মীরা যদি সম্মান জানায়, তা’হলে বুঝতে হবে, পদ নয়, ব্যক্তিটিকেই তারা সম্মান করছে পদে থাকার সময় তার কর্মকা- ও ব্যবহারের জন্য। অধ্যাপক আহমদ শরীফ বলতেন, ‘কর্মস্থল থেকে অবসর নিলে আর সেখানে না যাওয়াই শ্রেয়।’ অন্যান্য দেশে এমনটি ঘটে না। এমন কি ভারতেও দেখেছি, উচ্চপদে যারা কাজ করেন তখন এবং অবসর গ্রহণের পর প্রায় ক্ষেত্রে তাদের জীবনচর্যার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। এ সমাজে প্রায় সবাই পদের আকাক্সক্ষী এবং সেটি যদি সরকারী হয় তা’হলে আরও ভালো। সরকারী চাকরির বাইরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও সরকারী পদের প্রতি আকর্ষণ লুপ্ত করা যায়নি। এ পদের মোহ সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলের বঞ্চনা এই পদের প্রতি মোহ আরও দুর্বার করে তুলেছিল। আশা করা হয়েছিল স্বাধীন দেশে, স্বাধীন পেশার প্রতি সবাই আকাক্সক্ষী হবে, কিন্তু তা হয়নি। এই পদের প্রতি আগ্রহ মধ্যবিত্তের বেশি। উনিশ শতক থেকে মধ্যবিত্তের বিকাশ। সে বিকাশের কথা এখানে আলোচনা করব না। বিশ শতকের প্রথমার্ধে পূর্ববঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবলম্বন করে বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ হতে থাকে। পাকিস্তান আমলে এর গতি খানিকটা বৃদ্ধি পায়। স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে মধ্যবিত্তের দ্রুত বিকাশ হয়েছে নানা কারণে। কিন্তু, চারিত্রিকভাবে ইউরোপে যাকে বুর্জোয়া বলা হয় তা এখানে অনুপস্থিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থিতু হওয়ার পর প্রশাসনিক কারণে, অধস্তন কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এবং এর প্রধান কারণ ছিল প্রশাসনিক কেন্দ্রীভূতকরণ। এ কারণে ‘আনকভেনেন্টেড’ বা প্রাদেশিক সার্ভিসের, যেমন- আইন, রাজস্ব, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি দফতরের পদগুলো ভারতীয়দের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। পদে যোগদানের বা সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল শিক্ষা। ঔপনিবেশিক সরকারে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, জমির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে না পেরে মধ্যস্বত্বের অধিকারী সন্তানরা বিভিন্ন হাই স্কুলগুলোতে ভিড় জমিয়েছিল এবং সরকারী চাকরি পাবার আশায় ইংরেজী শিখছিল। এ জন্য তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছিল বিভিন্ন জেলা স্কুল, আবার কলেজিয়েট বা পোজগ স্কুলের মতো কিছু স্কুল এবং ঢাকা কলেজ। এক হিসেবে জানা যায়, ঢাকা বিভাগে ১৮৮১ সালে হাইস্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ছিল ৫৯১ জন এবং ১৮৯১ তে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ১০,৩৭১ জনে। নতুন এই পেশাজীবী শ্রেণীর যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তারাও গ্রামের বাসিন্দা এবং তারাও কোনো না কোনোভাবে গ্রামের ওপর নির্ভরশীল। মধ্যস্বত্বের অধিকারীদের পড়তি অবস্থা, জমিদারীর ভাঙ্গন প্রভৃতি বাধ্য করেছিল তাদের জীবিকা অর্জনের নতুন পথ খুঁজে নিতে। যেমন, সিলেটের রাধানাথ চৌধুরীর কথা ধরা যাক। তার পিতামহ ছিলেন জমিদার। রাধানাথের জন্মের সময় জমিদারীর অবস্থা পড়ে গিয়েছিল। তার ভাইরা কেরানী অথবা ছোটখাটো চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের কৃতী ব্যক্তিরা যাঁরা আত্মজীবনী লিখেছেন তাঁদের প্রায় সবার লেখার মধ্যেই এ চিত্রটি ফুটে উঠেছে। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের জমির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সে জমির পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এত কম যে তাতে সংসার চলে না, ফলে জীবিকার জন্যে তাকে অন্য পথ খুঁজে নিতে হয়েছিল। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা এবং তারপর কলকাতা। ঢাকা ব্যবসা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র, ইংরেজী স্কুল কলেজ আছে সেখানে। ফলে সেখানে খানিকটা শিক্ষালাভ করে একটি চাকরির বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। সুতরাং সে গ্রাম থেকে পাড়ি জমাত ঢাকা অথবা আত্মীয়স্বজন আছে এমন কোনো মফস্বল শহরে। সেখানে জায়গীর থেকে অথবা কয়েকজন মিলে মেস করে শুরু করত পড়াশোনা এবং শিক্ষা শেষ হলে বা শিক্ষারত অবস্থায়ই তার আত্মীয়স্বজনরা তাকে কোন একটি চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করত। ঔপনিবেশিক সরকারের চাকরি পাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল শিক্ষা। ঔপনিবেশিক সরকার শিক্ষার ধাঁচ আবার এমন করেছিল, যার ফলে এ শিক্ষা মাধ্যম থেকে যারা এসেছিলেন তারা হয়েছিলেন অনুকরণকারী, সিভিল সার্ভিসের যে কোনো পদের আকাক্সক্ষী যা তাদের অর্থ ও ক্ষমতা দেবে। ঔপনিবেশিক সরকারের চাকরিতে যারা গিয়েছিলেন তারা টাকা জমিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন জমিতে। কিন্তু সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করেননি ব্যবসায় বা বাণিজ্যে। কারণ ঔপনিবেশিক গঠনে, মেট্রোপলিটন পুঁজির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা যেতে চাননি অনিশ্চয়তার কারণে। এ বিষয়ে রক্ষণশীল মধ্যশ্রেণীর পত্রিকা হিন্দু রঞ্জিকাও আক্ষেপ করে লিখেছিল, দিন দিন মধ্যশ্রেণীর বিশেষ করে ভদ্রলোকদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে, কারণ তাদের ফাঁকা গর্ব এবং স্বাধীন ব্যবসায় নামার লজ্জা। এ অবস্থা চললে দেশের কোনো উন্নতি হবে না। চাষীরা এখন কেরানীদের থেকেও ভালো আছে, কারণ সাংসারিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা সবকিছু করতে প্রস্তুত। যদি কেউ একটু উঁচু পদের চাকরি করেন তাহলে সবাই তার ওপর নির্ভরশীল হবে তবুও স্বাধীন ব্যবসায় কেউ নামবে না। স্বাধীন ব্যবসায় না যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে শিক্ষা সম্পর্কে ফাঁকা গর্ব। কিন্তু যে কারণে জমিদাররাও স্বাধীন ব্যবসায় বা শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করেননি, সেই একই কারণে মধ্যশ্রেণী ব্যবসায় যেতে চাননি। (চলবে)
×