ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

বঙ্গবন্ধু চিরায়ত বাঙালী

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৭ মার্চ ২০১৫

বঙ্গবন্ধু চিরায়ত বাঙালী

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে ততদিনে। তারই অভিঘাত যদিও আসেনি এই বঙ্গদেশে, তবুও ভারতবর্ষে তখনও আঁধার কেটে আলোর ঝর্ণা বইছিল না। দখলদার শ্বেতাঙ্গ শাসকরা নিজেরা আলোকিত হলেও উপমহাদেশ জুড়ে অন্ধকারের বাতাবরণ। মানুষ চায় শোষণ, নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন সত্তার বিকাশ ঘটাতে। কিন্তু শাসকের শক্তিমত্তার কাছে তা অসহায়ত্ব ছাড়া কিছু ছিল না। এমনই পরিবেশ তখন দেশজুড়ে। আর তখন পৃথিবীর মানচিত্রের বিশালত্বের ভেতর টুঙ্গিপাড়া নামক গ্রামটি, পৃথিবীর বিচ্ছিন্নতম গ্রামটিতে একদিন আলোর ফোয়ারা জ্বেলে জেগে উঠেছিল বাংলার প্রাণমন আপ্লুত করে এক মানবশিশুর কান্নাহাসির উতরোল। একটি শতক আগে অর্থাৎ বিশ শতকের পাদপ্রান্তে তখন মানুষ রণক্লান্ত। মহাযুদ্ধ শেষে পৃৃথিবীর ঘরে ঘরে তখনও উৎকণ্ঠা। মানবতার অপমান বেজে ওঠে। ফুলের কুঁড়িরাও নিজের ইচ্ছামতো ফুটতে পারে না তখন আর। ঠিক সে সময় আকাশের মতো বিস্তীর্ণ, প্রান্তরের মতো উদার এক শিশু স্পর্শ রাখল বাংলার সবুজ মাটিতে। কালের প্রবাহ ধরে আলোকিত শিশুটিই ‘আরও আলো চাইগো’ বলে সারাদেশ তোলপাড় করে ছড়িয়ে দিয়েছিল সূর্যের শিরায় শিরায় বাংলার প্রাণ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় চৈত্র দিনের গান, বসন্তকালের আলো-হাওয়া প্রবাহিত তখন, আর এরই মাঝে আবির্ভূত হলেন বাংলার সহস্রবর্ষের সাধনার নাম; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুধু একটি নাম নন, হলেন একটি জাগ্রত ইতিহাস। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহঙ্কার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালী এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের অস্তিত্বস্পর্শী অমর নাম। ন্যায়, সত্য, কল্যাণ এবং আত্মমুক্তির পক্ষে সোচ্চার উদার হৃদয় মহান মানুষ। কোন প্রকার সঙ্কীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাঁকে স্পর্শ করেনি কখনও। বাঙালিত্ব ছিল তাঁর অহঙ্কার। এই বাঙালীকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতায়। কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছার অনিন্দ্য কুসুম ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তারই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ে বাঙালী জাতি। সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। জাতির শোণিতে শিরায় অকুতোভয় সাহস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দুঃসময়, হতাশার সমস্ত বাধার দেয়াল ভেঙ্গে দীর্ঘ পরাজিত, শোষিত, বঞ্চিত জাতিকে স্বাধীনতার সূর্যস্নানে স্নাত করিয়েছেন। তাই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উচ্চারিত হয় ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় সিক্ত একটি নাম; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম অবিরাম প্রতি সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে অক্ষয়-অম্লান। চিরদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে শৌর্যে-বীর্যে বহমান নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নাম হয়ে প্রজ্বলিত যুগ থেকে যুগে। বঙ্গবন্ধু তো শুধু একটি নাম নন, তিনি হলেন একটি জাতির জাগ্রত ইতিহাস। একটি জাতির জন্মদাতা। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহঙ্কার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালী এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। অসমাপ্ত সেই জীবনী। ঘাতকের উদ্যত সঙ্গিন সেই রচনা সমাপ্ত হতে দেয়নি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং তাদের দেশী-বিদেশী এজেন্টরা বাঙালিত্বের চেতনা এবং স্বাধীনতার সমস্ত অর্জনকে নস্যাত করে দিতে বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানে। যে শালপ্রাংশু, সিংহহৃদয় মহান মানুষটি অসীম দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি তর্কাতীত ভালবাসা, অনমনীয় দৃঢ়তা, ভয়-দ্বিধাহীন প্রত্যয় এবং কঠোর অধ্যবসায়কে সম্বল করে ক্রমে ক্রমে ইতিহাসের দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছেন। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক এবং সর্বোপরি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা পেয়েছেন। তাঁকে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট দস্যুর মতো রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র অবস্থায় পরিজনসহ হত্যা করা হয়েছিল। এ যে জাতির জন্য কত বড় গ্লানি, অপমান ও লজ্জার কথা; তা অবর্ণনীয়। কিন্তু ইতিহাসের চাকা, সভ্যতার চাকাকে নিষ্পেষিত করে ঘাতকরা বাঙালী জাতির জীবনে সৃষ্টি করেছিল ট্র্যাজেডি। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম যে মহান মানুষটির, তাঁর জীবন ও কর্ম একটি জাতির জীবনকে দিকনির্দেশনা দেয় প্রতিমুহূর্তে। মানুষের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ শেখ মুজিবকে এক মহানপ্রাণ মহামানবে পরিণত করার দিগন্ত উন্মিলিত করেছে। বাঙালী জাতির প্রাণপ্রবাহ এবং ধমণীতে তিনি সাহসের মন্ত্র বুনে দিয়েছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। বাংলার অবহেলিত এবং হতভাগ্য জনগণের কল্যাণ কামনায় সর্বক্ষণ ব্যাপৃত ছিলেন। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে তাঁর অত্যন্ত ব্যস্ততায়। একটি মুহূর্তকেও অপচয় খাতে প্রবাহিত করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালী জাতির সংগ্রামী জীবনধারার প্রতিটি সিঁড়িতে ছিলেন তিনি এককভাবে অগ্রসরমান। সকলকে পেছনে রেখে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন একটি পশ্চাৎপদ ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার কঠিন কাজটি সম্পাদনে। একটি জাতির জাগরণ, একটি জাতির অভ্যুত্থান, একটি রক্তাক্ত একাত্তর এবং একটি স্বাধীনতা- সবকিছুই সম্ভব হয়েছে একক নেতৃত্বে। আর এই যুগান্তকারী কালজয়ী নেতাই হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী যাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত-সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের। জাতি জানে, এসব অর্জন সম্ভব হয়েছিল একজন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে। ছিলেন দূরদর্শী, দুঃসাহসী, আপোসহীন। সততা, কর্মনিষ্ঠতা, কর্মকুশলতা- সব কিছু মিলিয়ে এক অতুলনীয় মানবে পরিণত করেছিল শেখ মুজিবকে। হয়ে উঠেছিলেন বাঙালী জাতির জীবনে আপন দ্যুতিতে প্রজ্বল এক অবিনাশী ধ্রুবতারা। সহস্র বছরের সাধনা শেষে বাঙালী জাতি পেয়েছে তার মহানায়ককে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীকে। শেখ মুজিবুর রহমানের পুরোজীবনটাই নিবেদিত তার দেশ, জাতি ও জনগণের জন্য। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জাতির প্রতি যে অপরিসীম ভালবাসা, তা প্রমাণ করে গেছেন। জীবনের পুরো পথ পরিক্রমায় বাঙালীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাকার ছিলেন। নিরন্ন, দুঃখী, অভাবী, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জাতির দুর্ভোগ মোচনে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে অগ্রসেনানীর দায়িত্ব পালন করেছেন। দাঙ্গাপীড়িত বাঙালী-অবাঙালীকে রক্ষায় জীবনবাজি রেখে এগিয়ে গিয়েছেন। লোভ- মোহের উর্ধে ছিলেন বলেই শাসকের নানা প্রলোভন উপেক্ষা করে দুঃসাহসে প্রতিবাদ-প্রতিরোধী হয়েছেন। দিনের পর দিন কেটেছে কারাগারে। লৌহকপাটের অন্তরালে কখনও ভেঙ্গে পড়েননি। হতাশা গ্রাস করেনি। শাসকদের সমঝোতার পথকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভোগ, বিলাস, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ইত্যাদিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বাঙালী জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আপোসহীনভাবে লড়াই করে গেছেন শেষদিন পর্যন্ত। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সগর্বে ঘোষণা করেছেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সেই সাহসী উচ্চারণ অহেতুক ছিল না। প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বাঙালী জাতিকে দাবিয়ে রাখা সহজসাধ্য নয়। এই ঘুমন্ত জাতিটিকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। যে জাতি কখনও বন্দুক-বেয়োনেট দেখেনি সে জাতি একাত্তরে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছে বাঁশের লাঠি, লগি-বৈঠা ফেলে। ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ হিসেবে জেনেছেন তিনি। ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহের উত্তাপ বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন। তাই জাতিকে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে পরাধীন-পর্যুদস্ত থেকে থেকে যে জাতিটি আধমরা থেকে পুরো মরায় পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ; বজ্রহুঙ্কারে শুধু নয়, আদরে-সোহাগে প্রাণের প্রবাহে স্পন্দন তুলে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। (চলবে)
×