ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিনিয়র নেতারা কৌশলে এড়িয়ে চলছেন খালেদা জিয়াকে

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৬ মার্চ ২০১৫

সিনিয়র নেতারা কৌশলে এড়িয়ে চলছেন খালেদা জিয়াকে

শরীফুল ইসলাম ॥ নেতিবাচক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী বাদ দিয়ে আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন না করায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলছেন দলের সিনিয়র নেতারা। আন্দোলন কর্মসূচীতে সাড়া না দেয়ায় খালেদা জিয়াও তাঁদের প্রতি ক্ষুব্ধ। এ কারণে আগের মতো ১৩ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে ওই সব নেতাদের গুলশান কার্যালয়ে ডাকেননি খালেদা জিয়া। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে হরতাল-অবরোধের পরিবর্তে বিকল্প কর্মসূচী ঘোষণা না করায় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই হতাশ হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা যায়, টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী সফল না হওয়া এবং এ কর্মসূচী চলাকালে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আরও আগেই আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের সিনিয়র নেতারা। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁদের পরামর্শকে উপেক্ষা করে লন্ডনপ্রবাসী ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে টানা অবরোধ-কর্মসূচী পালন করেই যাচ্ছেন। একপর্যায়ে দলের সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। আর বিষয়টি টের পেয়ে খালেদা জিয়াও এখন আর তাঁদের পরামর্শ নেন না। খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের পর ১৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনের সময় সব সিনিয়র নেতাদের তাঁর পাশে বসিয়েছিলেন। কিন্তু ১৩ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে তিনি কাউকে গুলশান কার্যালয়ে ডাকেননি। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, চেয়ারপার্সন সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্য ও কর্মসূচী ঘোষণার আগে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোন কথা বলেননি। তবে তিনি যা ভাল মনে করেছেন তাই করেছেন। এ বিষয়ে বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন আর দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত নেন না। সিনিয়র নেতারা আন্দোলনে মাঠে না নামায় তিনি ক্ষুব্ধ। তাই ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শ নিয়ে তিনি এখন আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের অনেক নেতাকর্মীই আশা করেছিলেন তিনি হয়ত আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করবেন। কিন্তু তা করা হয়নি। তিনি হয়ত মনে করেছেন এভাবে টানা কর্মসূচী পালন করেই আন্দোলনে বিজয়ী হতে পারবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলেও আগে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং সংবাদ সম্মেলনসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ কোন কর্মসূচী থাকলে সেখানে হাজির হতেন। কিন্তু টানা অবরোধ-হরতাল ও এর কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় তিনি নিজেও এখন অস্বস্তিতে ভুগছেন বলে জানা গেছে। আর এ কারণেই তিনি এখন খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলছেন বলে জানা যায়। তিনি এখন ধানম-ির বাসায় অবস্থান করছেন এবং মাঝে মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবরোধ চলাকালে প্রথমদিকে মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এখন অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তিনি গুলশানের বাসায় অবস্থান করেই আইন পেশাসহ ব্যক্তিগত কাজকর্র্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তাঁর বাসা গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের কছে হলেও এখন আর সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন এক সূত্র জানিয়েছে, সংবাদ সম্মেলন করে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও এখন এড়িয়ে চলছেন বলে জানা গেছে। তিনি এখন দিনের অধিকাংশ সময় বনানী ডিওএইচএসের বাসায় অবস্থান করেন এবং মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী শুরুর প্রথমদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে আন্দোলনের বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। তিনি আগের মতোই এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় অবস্থান করলেও এখন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। তিনি এখন শুধু খালেদা জিয়াকেই নয় কৌশলে বিএনপি নেতাকর্মীদেরও এড়িয়ে চলেন বলে জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম আন্দোলন শুরুর প্রথমদিকে সরাসরি ফোনে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি যশোরের বাসা থেকে আত্মগোপনে চলে যান। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের অতি নিকটে নিজ বাসায় অবস্থান করলেও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান এখন আর খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী শুরুর পর থেকেই পালিয়ে বেড়ালেও প্রথমদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে নেতাকর্মীদের আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য আহ্বান জানাতেন। কিন্তু এখন তিনি আর সেভাবে খালেদা জিয়া ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না বলে জানা গেছে। মির্জা আব্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন এক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার সম্ভাব্য মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীরা বেশ কিছুদিন আগেই জানিয়েছিলেন নির্বাচনের তৎপরতা শুরু হলে যেন আন্দোলন কর্মসূচীতে পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়। মির্জা আব্বাসের অবস্থানও এমনই ছিল। কিন্তু সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথে বিএনপি নেতাকর্মীদের সামনে বড় বাধা পড়েছে বলে জানা যায়। এক সময় খালেদা জিয়া ও দলের পক্ষে সরব বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনালে (অব) আসম হান্নান শাহ চলমান আন্দোলন দীর্ঘায়িত হওয়ায় এখন কৌশলে খালেদা জিয়া ও দলের নেতাকর্মীদের এড়িয়ে চলছেন। অবশ্য তিনি বর্তমানে অসুস্থ থাকায় মহাখালী ডিওএইচএসের বাসার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া সুপ্রীমকোর্টে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির ব্যানারে হরতাল-অবরোধের পক্ষে কর্মসূচীতে অংশ নিলেও রাজপথের কর্মসূচীতে অংশ নিচ্ছেন না। তিনিও এখন কৌশলে খালেদা জিয়াকে এড়িয়ে চলছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার জরুরী প্রয়োজন না হলে উত্তরার বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। অবশ্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখন কারাগারে রয়েছেন। আর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দুদকের মামলায় অভিযুক্ত ড. খন্দকার মোশাররফ ও আন্দোলন চলাকালে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী কারাগারে অবস্থান করছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী থেকে দূরে থাকতে খালেদা জিয়া ও দলের অন্য নেতাদের এড়িয়ে চলছেন। এছাড়া মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, মোর্শেদ খান ও আলতাফ হোসেন চৌধুরীও বিভিন্ন কৌশলে আন্দোলন কর্মসূচী থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা আন্দোলন শুরুর অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য গেলেও মাঝে মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে দলের পক্ষে কথা বলতেন। তিনিও এখন নীরব হয়ে গেছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে মাঝে মধ্যে দলের পক্ষে কথা বললেও এখন আবার নীরব হয়ে গেছেন। চেয়ারপার্সনের আরেক উপদেষ্টা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে দুই দিন অবস্থানের পর কৌশলে বের হয়ে যান। এর পর থেকে তিনি আর খালেদা জিয়া ও বিএনপির কোন নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, বর্তমানে যাঁরা গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন তাঁদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলেন খালেদা জিয়া। তবে তাঁরা খালেদা জিয়া যা বলেন তাতে সায় দেয়া ছাড়া আর কিছু বলেন না। ৩ জানুয়ারি থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে রয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এম এ কাইয়ুম। এ ছাড়া ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। কিন্তু গ্রেফতার এড়াতে এরপর আর তিনি গুলশান কার্যালয় থেকে বের হননি। ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গুলশান কার্যালয়ে আসার দিনে নজরুল ইসলাম খানও গুলশান কার্যালয়ে এসেছিলেন। এর আগে তিনি চিকিৎসার জন্য গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং সেখান থেকেই দলের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন। ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচী শুরু করে বিএনপি জোট। ৩ জানুয়ারি থেকে বাসা ছেড়ে গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারি বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকেই তিনি টানা অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। সেখান থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে বাধা না থাকলেও এখন পর্যন্ত বের হওয়ার চেষ্টা করেননি। ১৯ জানুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর দিনেও তিনি অন্যান্য বছরের মতো শেরেবাংলা নগরে মাজার জিয়ারত করতে যাননি। এমনকি ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতেও ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যাননি। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে তিনি গুলশান কার্যালয় থেকে বের হবেন কিনা, এ নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা।
×