ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একুশ শতক ॥ রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিক বাংলা কীবোর্ড

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৫ মার্চ ২০১৫

একুশ শতক ॥ রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিক বাংলা কীবোর্ড

॥ দুই ॥ কম্পিউটারে বাংলা কীবোর্ড তৈরির ইতিহাসটা খুব বেশিদিনের নয়। একেবারে অনেক পেছনে গেলে সেটি ১৯৮১ সালের দিকে শুরু হয়। হেমায়েত হোসেন এ্যাপল সিরিজ কম্পিউটারের জন্য বাংলা কীবোর্ড তৈরি করেন। বাংলাদেশে ডসের জন্য কীবোর্ড তৈরি হয় আবহ সফটওয়্যারে। আবহ সফটওয়্যারটি শামসুল হক সাহেব তৈরি করেন। তিনি মুনীর কীবোর্ডকে অনুসরণ করেন। ডসের জন্য বর্ণ নামের আরও একটি সফটওয়্যার তৈরি হয়। সেটাও রোমান বর্ণকে অনুসরণ করেনি। আমি স্মরণ করতে পারি, সেই সময়ে শহীদলিপিই প্রথম অপটিমা মুনীরকে এড়িয়ে যায়। শহীদলিপির সময়েই আমি তৈরি করি বিজয়। বলা ভাল, শুরুতে আমি শহীদ মুনীর চৌধুরীর টাইপরাইটারের কীবোর্ড অনুসরণ করে চার স্তরের একটি কীবোর্ড তৈরি করি। তাতে মুনীর কীবোর্ডের সঙ্গে কেবল দুটি নতুন স্তর যোগ করা হয়। তখনও কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তাক্ষর বানানোর বিষয়টির কথা ভাবিনি। তাতে বড় অসুবিধা হয় যে, কমপক্ষে ১৮৮টি বোতাম মনে রাখতে হতো। সেটি টাইপের গতি কমানো ছাড়াও অহেতুক জটিলতা তৈরি করে। বস্তুত বাংলাদেশে এ্যাপল মেকিন্টোসে এ রকম প্রোগ্রামিং করার মানুষের সন্ধানও আমার কাছে ছিল না। সেই কাজটি আমাকে করতে হয় ভারতে গিয়ে। পরে ২ স্তরের কীবোর্ড বানানোর সময় আমি বাংলা ভাষার মাধুর্য বা বিজ্ঞানসম্মত দিকটি কাজে লাগাই। বাংলা হরফের অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ ও হসন্তের ব্যবহারকে আমি কীবোর্ডের প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করি। সেই কারণেই বিজয় কীবোর্ড এখনও পেশাদারিত্বের সেরা। আমরা যদি সেই সময়কালে কম্পিউটারে বাংলা কীবোর্ড প্রচলনের ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে লক্ষ্য করব যে, অনেকেই নানাভাবে বোতামে বাংলা অক্ষর সাজিয়ে কীবোর্ড বানাতে থাকেন। মাহমুদ হোসেন ও ড. জাফর ইকবাল ম্যাকের জন্য উদয়ন নামের ফন্ট-কীবোর্ড বানান। প্রশিকা শব্দ নতুন কোন কীবোর্ড বানায়নি। তাদের সফটওয়্যারে বিজয় অনুমতি নিয়ে যুক্ত করা হয়। সাইটেক একাডেমি কীবোর্ড বানাতে গিয়ে বিজয়কে অনুসরণ করে। লেখনী নিজস্ব কীবোর্ড বানালেও বিজয়কে যুক্ত করে। পরবর্তীতে যিনি যাই বানান না কেন নামে বেনামে বিজয় যুক্ত হতে থাকে। বিজয় থেকে ইউনিজয় ও ইউনিবিজয় নাম প্রচলিত হয়ে ওঠে। আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কম্পিউটারের বাংলা সফটওয়্যার বিক্রি শুরু হয় আবহ থেকে। এরপর বর্ণ, শহীদলিপি ইত্যাদি বিক্রি হতে থাকে। ১৯৯৩ সালে উইন্ডোজ সংস্করণ প্রকাশের আগে ম্যাকের জন্য বিজয় ফ্রি বিতরণ করা হতো। এখনও সরকার নানা নামের বাংলা সফটওয়্যার অর্থ দিয়ে কিনে থাকে। তবে বিনামূল্যে বাংলা সফটওয়্যার বিতরণের সূচনাটাও প্রধানত ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই হতে থাকে। ইউনিকোড পদ্ধতিতে বাংলা লেখার উপায় চালু হওয়ার পর বহু সফটওয়্যার অচলও হয়ে যায়, নতুন সফটওয়্যারের জন্মও হতে থাকে। এটি বাস্তবতা যে, কম্পিউটারের বাংলা লেখা যখন ইউনিকোডভিত্তিক হয় এবং ইন্টারনেটকে যখন বাংলা লেখার একটি বড় ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় তখন থেকেই রোমান হরফে টাইপ করে বাংলা লেখার পদ্ধতি জনপ্রিয় হতে থাকে। এক্ষেত্রে অভ্র জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। আমি অবাক হইনি এটি দেখে যে, অভ্র নামক কোন কীবোর্ড নেই। এটি আসলে রোমান হরফে বাংলা লেখার একটি বিশেষ উপায়। আমাদের তরুণরা এই পদ্ধতিটিকে সহজতর উপায় বলে বিবেচনা করতে থাকে এবং কালক্রমে ফেসবুক স্ট্যাটাস লেখার একটি খুবই জনপ্রিয় উপায় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এসব বাংলা লেখালেখিতে প্রচুর পরিমাণ ভুল থাকে এবং লেখকরা যা লিখতে চান তা সঠিকভাবে সহজে লিখতে পারেন না। এর কারণটি অতি সহজ। এটি প্রণিধানযোগ্য যে, রোমান হরফে যুক্তাক্ষর তো দূরের কথা অনেক সাধারণ ব্যঞ্জনবর্ণও লেখা যায় না। যেসব বাংলা হরফ একটি রোমান হরফ দিয়ে লেখা যায় না তার সংখ্যাও কম নয়। ঋ, ঙ, চ, ঞ, ণ, ত, থ, দ, ধ, শ, ড়, ঢ়, য়, ং, ৎ, ঃ, ঁ লেখার জন্য কোন রোমান বর্ণ ব্যবহার করা যায় না। এ ছাড়াও বাংলা মহাপ্রাণ বর্ণগুলো লেখার জন্য একাধিক বর্ণ টাইপ করতে হয়। খ, ঘ, ছ, ঝ, ঠ, ঢ, শ, ষ ইত্যাদি বর্ণও কোন রোমান হরফে লেখা যায় না। এগুলো লিখতে ইংরেজী য বর্ণটি বাড়তি যুক্ত করতে হয়। ফ ও ভ এর জন্য দুটি রোমান হরফ অবশ্য রয়েছে। তবে এর সঙ্গে প ও ব এর জন্যও আলাদা বর্ণ রয়েছে। রোমান হরফের কাঠামোতে যেমন স্বরচিহ্ন, ফলা, যুক্তাক্ষর নাই তেমনি নাই অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ পদ্ধতি। এমন একটি অবস্থায় রোমান হরফ দিয়ে লেখা মানে যে কি বিড়ম্বনা সেটি যারা লেখেন তাঁরাই উপলব্ধি করতে পারেন। রোমান হরফ দিয়ে তথাকথিত ফনেটিক পদ্ধতিতে বাংলা লেখার বিবরণী দেখলেই সেটি আরও স্পষ্ট হয়। সব জানার পরও আমার কাছে মনে হয়েছে যে, রোমান হরফের সঙ্গে উচ্চারণকে কাছাকাছি রেখে, বিজয়-এর অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ ও হসন্ত সংযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কি একটি রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিক বাংলা কীবোর্ড তৈরি করা যায়? এ রকম একটি চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে আমি একটি রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিক বাংলা কীবোর্ডের প্রস্তাবনা তৈরি করার প্রয়াস চালিয়েছি। এই প্রস্তাবনার প্রথম নিয়মটি হচ্ছে বিজয়-এর আবিষ্কার অনুযায়ী বাংলা যুক্তাক্ষরকে কীবোর্ডে না রাখা। কারণ বাংলা সকল অক্ষর প্রচলিত কোন কীবোর্ডে রাখা যাবে না। সিসার টাইপের হিসাবে ৪৫৪ ও শহীদ সাহেবের হিসাবে ৭ শত বাংলা হরফ কোনভাবেই কীবোর্ডে ঠাঁই পেতে পারে না। এজন্য যুক্তাক্ষর ও স্বরবর্ণ তৈরিতে হসন্ত ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ যুক্তাক্ষর ছাড়াও স্বরবর্ণের ক্ষেত্রেও বিজয়-এর মতো মাত্র অ-ও বাদে বাকিগুলোর জন্য হসন্ত প্রয়োগ করা। এই দুটি নিয়মই বিজয় কীবোর্ডের প্যাটেন্ট। এরপর বিজয় কীবোর্ডের প্যাটেন্ট অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ পদ্ধতিটি ব্যবহার করা যায়। আমরা বিজয় কীবোর্ডের মতোই ৫৫টি বোতাম ব্যবহার করতে চাই। র ফলা, য ফলা ও রেফ হবে বাড়তি তিনটি হরফ। এবার রোমান হরফের সঙ্গে উচ্চারণে মিলে তেমন অক্ষরগুলোর মাঝে বেশি ব্যবহৃতগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় স্থাপন করা যায়। এভাবে আমি ে কার, র, ট, াে কার, ি কার, ু কার, প, া-কার, স, ড, গ, হ, জ, ক, ল, য, ব, ন ও ম বর্ণগুলো স্থাপন করতে পারি। এসব বাংলা হরফের সঙ্গে কাছাকাছি উচ্চারণের রোমান হরফ রয়েছে। এর সঙ্গে অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ জোড় তৈরি করা যায়। সেজন্য ৈ কার, র ফলা, ঠ, ৗে কার, ী কার, ফ, অ, ষ, ঢ, ঘ, ঝ, খ, য ফলা, ভ, ণ ইত্যাদি বর্ণ স্থাপন করতে পারি। এরপর আমরা অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ জোড়ার কথা ভুলে গিয়ে বাকি বর্ণগুলোকে স্থাপন করতে পারি। এবার প্রয়োজন হবে ঋ, ঙ, ঞ, ত, থ, দ, ধ, শ, ড়, ঢ়, য়, ং, ৎ, ঃ, ঁ এবং রেফ বর্ণগুলোকে স্থাপন করা। আমরা এরই মাঝে জেনে গেছি যে, এই অক্ষরগুলোর সঙ্গে রোমান হরফ মেলাতে পারব না। তাই আমরা রোমান কীবোর্ডের যেসব বোতাম এখনও খালি আছে সেগুলোতে ব্যবহারের ঘনত্ব অনুসারে বাংলা অক্ষরগুলোকে বসাতে পারি। এমন অবস্থায় কেমন হতে পারে আমাদের পুরো কীবোর্ডটি? রোমান হরফের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা বর্ণগুলোকে বসিয়ে আমরা দেখতে পারি এই আনন্দময় কীবোর্ডটি কেমন হতে পারে? ধরে নিলাম এর নামই আনন্দ। এবার আমরা ইংরেজি বর্ণের সঙ্গে বাংলা হরফগুলোকে বসাতে পারি। বোতামে অ া, অ; ই বোতামে ব, ভ; বোতামে ঈ, চ, ছ; উ বোতামে ড, ঢ; ঊ বোতামে ,ে ;ৈ ঋ বোতামে হসন্ত,। ; এ বোতামে গ,ঘ; ঐ বোতামে হ, ৃ; ও বোতামে ,ি ী; ঔ বোতামে জ, ঝ; ক বোতামে ক,খ; খ বোতামে ল,র্ (রেফ); গ বোতামে ম, শ; ঘ বোতামে ন, ণ; ঙ বোতামে ু, ূ; চ বোতামে প, ফ; ছ বোতামে ঙ, ং; বোতামে জ র, ্র (র) ফলা, ঝ বোতামে স, ষ; ঞ বোতামে ট, ঠ; ট বোতামে ও, ৗ; ঠ বোতামে দ, ধ; ড বোতামে য়, ঞ; বোতামে ঢ ত, থ; ণ বোতামে ড়, ঢ়; ত বোতামে য, ্য; ॥ বোতামে ৎ, ঃ এবং শিফট ৭ বোতামে ঁ (চন্দ্রবিন্দু)। এই উপমহাদেশের ভাষাগুলোর কম্পিউটার কীবোর্ডগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, রোমান হরফের মতো একটি প্রমিত কীবোর্ড এসব ভাষার জন্য প্রচলিত হয়নি। বরং প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই ডজন-হাফ ডজন কীবোর্ড রয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারী প্রমিত কীবোর্ড থাকলেও সেগুলোর প্রচলন মোটেই নেই। বাংলা ভাষার জন্য অসংখ্য কীবোর্ড তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে বিজয় একটি মানদ- দাঁড় করালেও ভারতে অবস্থা খুবই নাজুক। অন্যদিকে এভাবে প্রতিদিন নতুন নতুন কীবোর্ড তৈরি হলে জটিলতা আরও বাড়তে থাকবে। লেখাটির প্রথম সংস্করণটা এখানেই শেষ করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরই মনে হয়েছে যে, এর একটি আপডেট হতে পারে। সেই আপডেটটির বড় প্রয়োজন হচ্ছে তিনটি বাড়তি বর্ণ কীবোর্ড থেকে বিদায় করা। বস্তুত এসব বর্ণ নয়, ফলা বলা ভাল। এগুলো হলো র ফলা, য ফলা ও রেফ। তেমন একটি অবস্থায় রোমান কীবোর্ডর সঙ্গে পুরোই মিলে যাবে বোতাম ও বর্ণের সংখ্যাও। এবার একটু মিলিয়ে নেয়া যায় যে রোমান বোতামগুলোতে বাংলা কোন কোন অক্ষর বসানো যেতে পরে। এবার আমরা ইংরেজী বর্ণের সঙ্গে বাংলা হরফগুলোকে বসাতে পারি। বোতামে অ া, অ; ই বোতামে ব, ভ; বোতামে ঈ চ, ছ; উ বোতামে ড, ঢ; ঊ বোতামে ,ে ;ৈ ঋ বোতামে হসন্ত,।; এ বোতামে গ,ঘ; ঐ বোতামে হ, ৃ; ও বোতামে ,ি ী; ঔ বোতামে জ, ঝ; ক বোতামে ক, খ; খ বোতামে ল, ঢ় গ বোতামে ম, শ; ঘ বোতামে ন, ণ; ঙ বোতামে ু, ূ; চ বোতামে প, ফ; ছ বোতামে ঙ, ং; বোতামে জ র, ড়, ঝ বোতামে স, ষ; ঞ বোতামে ট,ঠ; ট বোতামে ও, ৗ; ঠ বোতামে দ, ধ; ড বোতামে ঞ, ঁ; ঢ বোতামে ত, থ; ণ বোতামে ৎ, ঃ; ত বোতামে য, য়; যদি আমরা কীবোর্ডটিকে এভাবে সাজাই তবে বাংলা লেখার সময় বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। ১) অ-ও ছাড়া সকল স্বরবর্ণ হসন্ত দিয়ে টাইপ করতে হবে। ২) সকল যুক্তবর্ণ হসন্ত দিয়ে যুক্ত করতে হবে। এমনকি র ফলা হলে হসন্ত র, য ফলা হলে হসন্ত য এবং রেফ হলে র হসন্ত টাইপ করতে হবে। তবে এমন একটি কীবোর্ড তৈরি করার সময় এই কথাটি বলতেই হবে যে এটি বাংলা টাইপ করার জন্য মোটেই বিজ্ঞানসম্মত কীবোর্ড নয়। বিজ্ঞানসম্মত কীবোর্ড হওয়ার জন্য বর্ণের ফ্রিকুয়েন্সি ব্যবহার করে হোম কীকে বিবেচনায় রেখে বর্ণ স্থাপন করতে হবে যেটি বিজয় কীবোর্ডে করা হয়েছে। (সমাপ্ত) ঢাকা, ১২ মার্চ, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×