ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী দমনে বিশেষ বাহিনী হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৪ মার্চ ২০১৫

জঙ্গী দমনে বিশেষ বাহিনী হচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিস্তাররোধে পৃথক একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা চলছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে সার্বিক আলোচনা শুরু হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাহিনী সৃষ্টির কার্যক্রম শুরুর কথা রয়েছে। সরকারের সব বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হচ্ছে বিশেষ ওই বাহিনী। বাহিনীটি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে কাজ করবে। কাউন্টার টেরোরিজমের বিষয়ে যদিও ২০০৯ সাল থেকেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাহিনীটি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যায় বাংলাদেশে জঙ্গীদের সুইসাইডাল স্কোয়াড থাকার খবরে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। স্কোয়াডের সদস্যদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। সম্প্রতি ত্রিশালে ফিল্মিস্টাইলে প্রিজনভ্যান থেকে পুলিশ হত্যা করে তিন জেএমবি জঙ্গী ছিনতাই, শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যা, বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপ হত্যা, গোপীবাগে কথিত বিশ্বত্রাণ কর্তা লুৎফুর রহমানসহ ৬ জনকে জবাই করে হত্যা, ফার্মগেট পূর্বরাজাবাজারে চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা এবং সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ততম টিএসসি এলাকায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক লেখক প্রকৌশলী অভিজিত রায় হত্যার ঘটনা ঘটে। অভিজিত হত্যা মামলার তদন্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে সহায়তা করছে। এসব হত্যাকা- উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে নতুন করে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের তৎপরতার বিষয়ে। যদিও ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতা নেয়ার পর একুশে আগস্ট, উদীচী, সিপিবি সমাবেশ, বাঙালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ, দেশবাপী সিরিজ বোমা হামলা, চার্চে বোমা হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা, সিলেটে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলাসহ অসংখ্য বোমা ও গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে এদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছিল। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, হালে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারের ধরন পাল্টে গেছে। ইন্টারনেটনির্ভর জঙ্গী তৎপরতা চলছে। তবে থেমে নেই তাদের সশরীরে দাওয়াতি কার্যক্রম। জঙ্গীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্ধারিত টার্গেট সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করছে। কয়েকটি ধাপের পরে চূড়ান্ত হামলার ঘটনা ঘটছে। ফলে হত্যাকা-ে জড়িত গোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেলেও সরাসরি হত্যাকা-ে জড়িতদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যেমনটি হয়েছে লেখক অভিজিত রায় হত্যাকা-ের বেলায়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৯টি জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে। যারা জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে এখনও মদদ ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। যদিও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাতের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যা ১২৫টি। এদের অধিকাংশই দেশে বিদেশে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত। জঙ্গী খাতে অর্থায়ন থেমে নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা লাভের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর অধীনে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও মনিটরিং সেল গঠিত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ইউনিট, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), অন্যান্য সকল গোয়েন্দা সংস্থা, শিক্ষা, শিল্প, অর্থসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সেলের সদস্য করা হয়। তাদের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। মনিটরিং সেল সূত্রে জানা গেছে, সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের অভাবে বাংলাদেশে ভেতরে ভেতরে দ্রুত জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটছে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের ব্যর্থতা এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী। বিমানবন্দর দিয়ে ঢুকছে বিভিন্ন দেশের জঙ্গীরা। তারা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও বাংলাদেশে দিব্যি থেকে যাচ্ছে। তাদের সম্পর্কে কোন তথ্য না থাকায় গ্রেফতার হচ্ছে না। আবার একইভাবে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গী ট্রেনিং নিতে পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তারা সেইসব দেশে কি কাজে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না। দেশে ফিরে তারা কোথায় কি করছে সে সম্পর্কে কোন মনিটরিং নেই। গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে পাকিস্তানের বহু জঙ্গী সংগঠন এদেশে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা বাংলাদেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করে বিদেশে নিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়াচ্ছে। আটকেপড়া বিহারীদের ক্যাম্পগুলোতে ভাষাগত সুবিধার কারণে বহু পাকিস্তানী ও ভারতীয় জঙ্গী আত্মগোপনে রয়েছে। সহিংস আন্দোলনের ককটেলের যোগান আসছে এসব বিহারী ক্যাম্প থেকেও। বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গীরা বাংলাদেশী জঙ্গীদের আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া জাল পাসপোর্ট, জাল সনদপত্র, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ধরা পড়ছে হরহামেশাই। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত অবৈধ বিদেশী নাগরিকদের অধিকাংশই বাংলাদেশে নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গীবাদ। তাদের ওপর কোন নজরদারি নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গছিয়ে ওঠা প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যূনতম কোন মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সে সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই সরকারের কাছে। সারাদেশে থাকা হাজার কওমী মাদ্রাসার ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মাদ্রাসা থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার ও গ্রেফতারের ঘটনা বহু পুরনো। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে জঙ্গীবাদ। ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গীবাদের অর্থ লেনদেন হচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করছে জঙ্গীরা। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশে আত্মঘাতী জঙ্গী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকার কথা জানান। আত্মঘাতী স্কোয়াডটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে বলেও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। যদিও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর আল কায়েদার পরবর্তী টার্গেট যে বাংলাদেশ, সে বিষয়টি ২০১০ সালের প্রথম দিকেই বিশ্বের প্রভাবশালী ১১১টি দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল ভারত উপমহাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আল কায়েদার প্রথম টার্গেট। হুজি ও জেএমবি আল কায়েদার ও লস্কর-ই-তৈয়বার সহযোগী সংগঠন। জঙ্গীবাদের বিস্তাররোধে সার্বিক সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারে বিশেষ তাগাদা দেয়া হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সরকার একটি পৃথক বিশেষ বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করছি অচিরেই বাহিনীটি আত্মপ্রকাশ করবে। দেশের সব বাহিনীর চৌকস, মেধাবী ও জঙ্গীবাদ সম্পর্কিত জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বাহিনীটি গঠিত হবে। বাংলাদেশে আত্মঘাতী জঙ্গী স্কোয়াডের সদস্য থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের কাছে এমন একটি গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর নজরদারি চলছে। সাইবার ক্রাইমরোধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের বহু আগেই ২০০৯ সালে বাংলাদেশে আত্মঘাতী জঙ্গী স্কোয়াড থাকার তথ্য প্রকাশ পায়। ওই বছর ১২ নবেম্বর বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস ও ভারতীয় দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে লস্কর-ই-তৈয়বার পাকিস্তানী জঙ্গী সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম আজহারী ওরফে সুফিয়ান, মোহাম্মদ আশরাফ ওরফে জাহিদ ও মোহাম্মদ মনোয়ার আলী ওরফে মনোয়ার গ্রেফতারের পর বাংলাদেশী আত্মঘাতী জঙ্গী স্কোয়াড থাকার তথ্য প্রকাশ পায়। গ্রেফতারকৃতরা লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য হলেও তারা মূলত আল কায়েদার সিস্টার জঙ্গী সংগঠন জঈশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য বলে ডিবি সূত্র জানায়।
×