ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রণাঙ্গনের ‘অগ্নিমূর্তি’

চলে গেলেন একাত্তরের আরেক সাহসী যোদ্ধা হাজারি লাল বীরপ্রতীক

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১৪ মার্চ ২০১৫

চলে গেলেন একাত্তরের আরেক সাহসী যোদ্ধা হাজারি লাল বীরপ্রতীক

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ চলে গেলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের ‘অগ্নিমূর্তি’ হিসেবে পরিচিত বীরপ্রতীক হাজারি লাল। গত ১০ মার্চ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। অগ্নিঝরা মার্চে তাঁর মৃত্যুতে যশোরবাসী মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সূর্যসৈনিককে হারালো। বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বীরপ্রতীক হাজারি লাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার রাণীয়ালি গ্রামের রসিক লাল তরফদারের ছেলে। তিনি এলাকায় গোসাই নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। ’৭১-এর রণাঙ্গনের বিজয়ী এ বীরকে স্বাধীনতার ৪৪ বছরে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। যশোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রাজেক আহমেদ জানান, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বীরপ্রতীক হাজারি লালের মৃত্যু হয়েছে। ভারতেই তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। রাজেক আহমেদ বলেন, হাজারি লালের মৃত্যুতে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন নিবেদিতপ্রাণকে হারালাম। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। একজন বীরপ্রতীক হাজারি লাল ॥ মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরের বয়রা সাবসেক্টরের কমান্ডার নাজমুল হুদার অধীনে হাজারি লাল যুদ্ধ করেছেন। তিনি বিভিন্ন সময় তাঁর সাক্ষাতকারে যুদ্ধজয়ের দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধের সকল স্মৃতিই তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তবে গঙ্গধরপুরের যুদ্ধের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। এই যুদ্ধের ঠিকঠাক দিন-তারিখ মনে না থাকলেও তিনি বলেন, বয়রা সাবসেক্টর কমান্ডার নাজমুল হুদার নির্দেশে চৌগাছা অপারেশন শেষে বয়রা ফেরার পথে কাগমারির কবির উদ্দিনের মাধ্যমে খবর পান গঙ্গধরপুর-রাজাপুর এলাকায় বর্বর পাকসেনারা ঢুকে পড়েছে। এ খবর শোনার পর পাকসেনাদের প্রতিরোধ করতে ক্যাপ্টেন হুদার নির্দেশ মতো তাঁরা ৪জন গোলাবারুদ নিয়ে নৌকায় রওনা দেন। এ চারজন হলেন রকেট জলিল, আবদুর রাজ্জাক, মশিয়ার রহমান ও হাজারি লাল। হাজারি লাল গঙ্গধরপুরের একটি ইটেরভাঁটির মধ্যে অবস্থান নেন। অসংখ্য পাকসেনা সেদিন একযোগে ওই এলাকায় প্রবেশ করে। মাত্র চারজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধ কৌশল এমন ছিল যে, পাকসেনারা ভেবেছিল তারা একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। সেদিনের যুদ্ধে ৫৬ পাকসেনা খতম হয়। এক পর্যায়ে তিনি লক্ষ্য করেন, শত্রু সেনারা তাকে ঘিরে ফেলেছে। এ অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। শত্রু সেনাদের দু’জনের একজন পাক ও অপরজন বিহারী রাজাকার। রাজাকারটির হাতে ছিল রামদা। সে ওই রামদা দিয়ে হাজারি লালকে হত্যা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু পাকসেনা তাকে জীবিত অবস্থা ঘাঁটিতে নিয়ে যেতে চায়। এ অবস্থায় হাজারি লাল কিছুটা দূরে অবস্থান করা রকেট জলিলকে লক্ষ্য করে বলেন ‘জলিল বন্দী হয়ে শত্রুর শিবিরে যাওয়ার চেয়ে মৃত্যু ভাল। তুই আমাকে গুলি কর।’ সঙ্গে সঙ্গে রকেট জলিল গুলি করেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই গুলি হাজারি লালের গায়ে না লেগে পাকসেনার গায়ে লাগলে লুটিয়ে পড়ে। তক্ষুনি হাজারি লাল তাঁর অস্ত্র দিয়ে রাজাকারকে গুলি করেন। হাজারি লালের সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় ঝিকরগাছার শিমুলিয়া অপারেশনে। মুক্তিযুদ্ধে বয়রা সাবসেক্টরের ভয়াবহ যুদ্ধে হাজারি লাল থাকতেন সবার আগে। পাকসেনাদের কাছে হাজারি লাল হয়ে ওঠেন মূর্তিমান আতঙ্ক। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। স্বাধীন বাংলার মাটিতে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা নিয়ে জীবনসংগ্রাম শুরু করেন। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে তিনি বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। যদিও স্বাধীনতার ৪৪ বছরে দারিদ্র্য, নির্যাতন আর নিষ্পেষণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছে এই বীর যোদ্ধাকে।
×