ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আইন সংশোধের উদ্যোগ

রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণ নিষিদ্ধ

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৪ মার্চ ২০১৫

রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণ নিষিদ্ধ

নিখিল মানখিন ॥ মানবদেহের কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিকিৎসার উন্নয়নে আইন সংশোধন করছে সরকার। এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া এখন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। আইনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন-২০১৪’। সংশোধিত আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার বিষয়ে কোন ছাড় দেয়া হয়নি। সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণ নিষিদ্ধ। অনাত্মীয়কে আত্মীয় পরিচয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপন বন্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেইন ডেথ) পর তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ থাকছে এ আইনে। মূলত ওই ব্যক্তির বা তাঁর উত্তরাধিকারের সম্মতিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করা যাবে। মিথ্যা তথ্য দিলে ২ বছরের কারাদ- এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। তবে সংশোধিত আইনে অপরাধী চিকিৎসকদের শাস্তি কমানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনটি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশের শীর্ষ কিডনি বিশেষজ্ঞরাই মূলত আইনটি সংশোধনের পরামর্শ দেন। ২০১১ সালে কিডনি কেনাবেচার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা কমে আসে। মূলত বিকল্প খুঁজতেই ব্রেইন ডেথ হওয়ার পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহকে উৎসাহ দিতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আইনটির নাম হবে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধিত) আইন-২০১২। পরবর্তীতে এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ রেনাল এ্যাসোসিয়েশন, ট্রান্সপ্লান্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনস ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আইনটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে নীতিগত অনুমোদন দিয়ে আরও যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়। জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আইনটির সংশোধনীর যে খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে চিকিৎসকদের শাস্তি কমানোর কথা বলা হয়েছে। খসড়া আইনে শুধু তাঁদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ মূল যে শাস্তিÑ সাত বা তিন বছরের সশ্রম কারাদ-, তিন লাখ টাকা অর্থদ- এবং উভয় দ-ের বিধান চিকিৎসকদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত একটি খসড়া আইনে রোগী সুরক্ষার চেয়ে চিকিৎসকদের স্বার্থই বেশি রক্ষা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আইনটি সম্পর্কে মতামত দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। ১৯৯৯ সালের আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। এবারের আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ বহাল রাখার পাশাপাশি বিষয়টিকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। খসড়া আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউট বা ক্লিনিককে অনুমতি নিতে হবে। তবে কোন ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ২০ শয্যার দুটি ইউনিট না থাকলে সরকার এ সংক্রান্ত অনুমতি দেবে না। এ ছাড়া এ ধরনের ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম দুটি অপারেশন থিয়েটার, আট শয্যার ট্রান্সপ্লান্ট আইসিইউ, কিডনি সংযোজনের জন্য ন্যূনতম ছয় শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন অধ্যাপক, দুজন সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক বা সমমানের চিকিৎসক থাকতে হবে। খসড়া আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করার পদ্ধতিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তাঁর নিকটাত্মীয়কে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিতে চাইলে সরকারের কাছে আবেদন করবে। আবেদন পাওয়ার পর আত্মীয়তা যাচাই-বাছাই করা হবে। দাতা-গ্রহীতার জন্ম নিবন্ধনপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্ট্যাম্পে হলফনামা দেবে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন, প্রয়োজনে বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এসব তথ্য যাচাই করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে অথেনটিফিকেশন বোর্ডে পাঠানো হবে। এই বোর্ড গঠন করা হবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন পরিচালক ও দুজন উপ-পরিচালকের সমন্বয়ে। দাতা-গ্রহীতার আত্মীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বোর্ড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এসব খুব দীর্ঘ ও রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। সংশোধনী আইনে আরও উল্লেখ রয়েছে, ক্যাডাভেরিক (মৃত) ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে জাতীয় কমিটি থাকবে। এ কমিটির কার্যক্রম পরিচালনা করবে ১৯ সদস্যের জাতীয় কমিটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কমিটির প্রধান হবেন। কমিটিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিনিধি, বিএমডিসির সভাপতি, বিএমএ সভাপতি বা তাঁর প্রতিনিধি, সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থাকবেন। এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক। এ কমিটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয়কারীর কার্যক্রম তদারকি করবে এবং ক্যাডাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন সহজ করার পরামর্শ দেবে। এ কমিটি মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে মৃত ব্যক্তি থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও সংযোজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ কমিটি বিভিন্ন ধরনের উপকমিটি গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য ট্রান্সপ্লান্ট কমিটি থাকবে। তবে প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ এ কমিটিতে থাকতে পারবে না। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের বিধান ॥ খসড়া আইন অনুযায়ী যেসব আইসিইউতে কোন রোগীর ব্রেন ডেথ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হবে, তাদের সঙ্গে সমন্বয়কারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে। বিযুক্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর আগে তার কোন আত্মীয়কে তার অঙ্গ দান করে গেলে সেটা অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
×