ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৩ মার্চ ২০১৫

আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা

রহিম শেখ ॥ বিএনপি জোটের চলমান অবরোধে সহিংসতা ও নাশকতাসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সুবিধা চান ব্যবসায়ীরা। তারা ক্ষতি মোকাবেলায় ঋণের সুদ মওকুফ, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো, কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করা, সুদের হার কমানোর সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি বন্দরের কাছে অতিরিক্ত মাসুল বকেয়া থাকলে তা থেকে অব্যাহতি চান ব্যবসায়ীরা। বীমার প্রিমিয়াম যাতে হ্রাস করা হয়, রয়েছে সে চেষ্টাও। এর বাইরে সহজ শর্তে ঋণের পাশাপাশি ইউরো অঞ্চলে রফতানিকারকরা চান সরকারের বিশেষ প্রণোদনা। তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব খাতের ব্যবসায়ীরাই এসব সুবিধা আদায়ের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের আর্থিক খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গবেষণা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সুদ মওকুফ হবে কি-না। জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় করণীয় নির্ধারণে সম্প্রতি দুটি কমিটি করেছেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে ব্যাংক ট্যাক্স বিষয়ক একটি উপকমিটি রফতানি খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যে ধরনের সুবিধা দেয়া দরকার সে বিষয়ে একটি সুপারিশ তৈরি করেছে। এসব সুপারিশ নিয়ে গত ২ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) থেকেও এসব বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়েছে। দ্রুতই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করা হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ব্যাংক ও ট্যাক্স বিষয়ক উপকমিটির প্রধান আবদুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা অচিরেই বন্ধ না হলে ক্ষতির তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। তখন আমাদের এখনকার তালিকা বাদ দিয়ে আবার নতুন তালিকা করতে হবে। ব্যবসায়ীরা শুধু ক্ষতিপূরণই চান না, তাঁরা ব্যবসা করতে চান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, প্রকৃত ক্ষতি বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়া যেতে পারে। উদ্যোক্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র দাবি, চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিভিন্ন খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দে’ড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৈরি পোশাক খাত। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন, পোলট্রি, হিমায়িত পণ্য, আবাসন, প্লাস্টিক এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাও। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন চলমান পরিস্থিতিতে আর্থিক ক্ষতির একটি হিসাব দেখিয়েছে। তাদের দাবি, প্রতিদিন এ খাতে ক্ষতি হচ্ছে ১০-১২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্লাস্টিক খাতের ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এটা পুষিয়ে নিতেই সরকারের কাছে বিভিন্ন সুবিধা চেয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, যেসব সুবিধা চাওয়া হচ্ছে তা কেবল পোশাক খাতের জন্য নয়। রফতানিমুখী সব শিল্প খাতের জন্যই এসব দাবি তোলা হচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবাই। তাই একক কোন খাতের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (এলএফএমইএবি)। সেই সঙ্গে সাময়িক সময়ের জন্য (১২ মাস) সুদহার ৭ শতাংশ কমিয়ে অর্থায়ন সুবিধাও চেয়েছে সংগঠনটি। রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানিকারক ও ডিলারদের সংগঠন বারভিডা বলছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। আমদানির পরও বন্দর থেকে সময়মতো গাড়ি ছাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। বিক্রিও কমে গেছে উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থায় বিশেষ সুবিধাপ্রার্থী তারাও। জানতে চাইলে বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন বলেন, পোশাক খাত-সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগে ব্যাংক-সংক্রান্ত যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে তা আমাদেরও। এর পাশাপাশি বন্দরে গাড়ির জট-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু দাবি আমরা পৃথকভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরব। গত দেড় মাসে প্রায় ১৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত মাসুল মওকুফের বিষয়টি এর অন্যতম। এফবিসিসিআই’র দেয়া তথ্য মতে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫ হাজার গাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ২শ’ গাড়ি পুড়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় একদিকে বীমা কোম্পানিগুলোর আয় কমে গেছে। অন্যদিকে বীমা গ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানিগুলো ক্ষতিপূরণ চাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব হবে না। এদিকে ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা তাদের ঋণ পুনর্গঠনের ব্যাপারে আবেদন করছেন। এছাড়ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ঋণের একটি অংশ ব্লক এ্যাকাউন্টে নিয়ে কিস্তি পরিশোধ স্থগিত, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের বিপরীতে বীমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে তৎপর রয়েছেন। এসব আদায়ে তারা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কর্মসূচীও ঘোষণা করেছেন। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনর্গঠনের ব্যাপারে বিশেষ ছাড় দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহীতাদের এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর আওতায় সুবিধা পেতে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে আবেদন করা যাবে। ফলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা এই সুবিধা নিতে আবেদন করতে পারবেন। এদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় কৃষকরাও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তাদের কৃষি ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতি পোষাতে ব্যবসায়ীদের যেহেতু বিশেষ ছাড় দিতে হবে, সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যবসা খাতের ক্ষতি নিরূপণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই দুই বছরে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ, আদায়, খেলাপী ঋণ, বিতরণযোগ্য তহবিল সম্পর্কে মাসওয়ারি তথ্য জানাতে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানি খাত ও ব্যাংকিং খাতের ক্ষতির বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে ২৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। শিল্প খাতে মেয়াদী ঋণ ৭৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। শিল্প খাতের চলতি মূলধন ঋণ ৯১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। নির্মাণ খাতে ৪৩ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। বাণিজ্য খাতে ১ লাখ ৯৭ হাজার ২৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪১ শতাংশ। পরিবহন খাতে ৫ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। ভোক্তা ঋণ ৩৪ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ১২ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। প্রাপ্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণের বেশির ভাগই রয়েছে শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্য খাতে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় এসব খাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ফলে এসব ঋণ খেলাপী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
×