ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খোদ তথ্যমন্ত্রীও কবুল করলেন প্রতিষ্ঠানটির নৈরাজ্যের কথা;###;মহাপরিচালকের চেয়ে দাপট বেশি উপ-মহাপরিচালকের;###;ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে অনুষ্ঠান ও সংবাদের মান;###;বার্তা বিভাগে আধিপত্য ভোল পাল্টানো জামায়াত-বিএনপি আমলের লোকজনের

সোনালি ঐতিহ্য হারাচ্ছে ॥ অস্তাচলে বিটিভি!

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৩ মার্চ ২০১৫

সোনালি ঐতিহ্য হারাচ্ছে ॥ অস্তাচলে বিটিভি!

মনোয়ার হোসেন ॥ ক্রমশই যেন ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে দেশের আপামর মানুষের সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। দিনে দিনে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমটি হারাচ্ছে দর্শকের গ্রহণযোগ্যতা। দক্ষ ও যোগ্য লোকের অভাবে ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে অনুষ্ঠান ও সংবাদের মান। প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতায় সুনাম হারাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সরকারী এই গণমাধ্যমটি। একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ ও দলীয় লেজুরবৃত্তিকারী কর্মকর্তার প্রশ্রয়েই এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে ভেতরে ঘাঁপটি মেরে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য ও ছদ্মবেশী দলবাজ কর্মকর্তা। বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মান্নান বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করলেও তাঁকে ডিঙিয়ে অনুষ্ঠান বিভাগের এক কর্তা মূল চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসবের সঙ্গে আছে ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পদ্ধতি ও গণহারে অযৌক্তিক পদোন্নতি এবং সরকারের ভুলনীতি। পাশাপাশি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা না থাকায় কেউ কারও কথা শোনে না। যার ফল হিসেবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে বর্তমানে বহুমুখী সমস্যায় আক্রান্ত বিটিভি। তাই একদিকে মানহীন অনুষ্ঠান অন্যদিকে উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির কারণে বিটিভি হারিয়েছে তার আবেদন। অথচ এই সম্প্রচার মাধ্যমটিই একসময় নাটক থেকে শুরু করে সঙ্গীতানুষ্ঠান কিংবা শিশুতোষ অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে মাতিয়ে রাখত দর্শকদের। এমনকি একটা সময় বিটিভির সংবাদও ছিল দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য। সেই সোনালি যুগ কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এখন বেহাল দশা। আর নিম্নমানের অনুষ্ঠানের কারণে দর্শক চোখ সরিয়ে নিয়েছে সরকারী এই টিভি চ্যানেল থেকে। এসব বহুমুখী সমস্যার উত্তরণে অনেকেই প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন চাইলেও ভেতরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। নিজেদের অদক্ষতা আড়াল করার জন্য তারা কখনোই এটির স্বায়ত্তশানের বিষয়টি মেনে নিতে চান না এবং পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিভিতে কর্মরত সূত্র জানায়, দায়সারাভাবে চালানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান ও সংবাদ বিভাগ। এ কারণে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম হয়েও সরকারের সাফল্য বা উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোন মন্ত্রীর বরাত দিয়ে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রচারে দেখা যায় ব্যাপক আগ্রহ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মান্নান প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করলেও তিনি সংবাদ বিভাগের কোন খোঁজখবর নেন না। আবার বার্তা বিভাগের উপমহাপরিচালক শাহিদা আলম চাইলেও ভাল কিছু করতে পারছেন না। কারণ, অনুষ্ঠান বিভাগের এক কর্তা অযাচিতভাবে নাক গলান এই বিভাগে। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা বিটিভিতে মহাপরিচালকের চেয়েও ক্ষমতাবান। অনুষ্ঠান কিংবা সংবাদÑ বিটিভির সব বিভাগেই রয়েছে তাঁর একক আধিপত্য। একইরকম অবস্থা বিরাজ করছে অনুষ্ঠান বিভাগে। এখানেও প্রচুর অনুষ্ঠান হলেও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠানেরই মানের বিবেচনায় দর্শক টানছে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই বিভাগে রয়েছে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম। একটি নাটকে ১০ জন কলাকুশলী লাগলে সেখানে বিল তোলা হচ্ছে ১৫ জনের। এমন ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। এছাড়া উপযুক্ত ব্যক্তির পরিবর্তে অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নিম্নমানের অনুষ্ঠান। আবার বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রায়শই পুরনো ফুটেজ দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়। অথচ বিল ঠিকই তৈরি হয় নতুনভাবে। আর এসব ক্ষেত্রে কোন বাছবিচার ছাড়াই বিল পাস করে দেন বিটিভির মহাব্যবস্থাক। এই কর্মকর্তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে বিশেষ কর্তাব্যক্তির। অনুষ্ঠান বিভাগের ব্যর্থতা ॥ দেশের একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল হয়েও প্রায়শই বিটিভির পর্দা ঝিরঝির করে, কাঁপতে থাকে ছবি, ভেঙে যায় শব্দ। শব্দ এগিয়ে যায় তো থেমে থাকে ছবি। আবার কখনও দৃশ্য এগিয়ে চলছে কিন্তু থেমে যাচ্ছে শব্দ প্রক্ষেপণ। এ প্রতিবেদন তৈরির সময় সোমবার রাত ১১টা পর প্রচারিত একটি নৃত্যানুষ্ঠানে তেমনটাই দেখা যায়। এছাড়া প্রমাণ হিসেবে গত ২৫ ডিসেম্বর বিটিভির জাঁকজমকপূর্ণ সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও ধরা পড়ে প্রতিষ্ঠানটির জীর্ণ দশা। সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে একঝাঁক শিল্পী গাইছিলেন আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে... গানটি। কিন্তু গানটি গাওয়ার সময় হঠাৎ করে থেমে যায় মাইক। কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে পরিবেশনা। প্রায় ১ মিনিটের কারিগরি ত্রুটি সারিয়ে আবার শুরু হয় গানের পরিবেশনা। আর এমন ঘটনা ঘটে থাকে হরহামেশাই। অনুষ্ঠানের নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকা- বা অসদুপায়ে টাকা কামানোর বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়ে গত বছরের ২৮ জুলাই। ওই দিন বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচিত মুসা বিন শমসেরকে ‘কৃতী বাঙালী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অর্থ পাচারের অভিযোগে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই ঘটনার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে অনুষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নাম আসায় পরবর্তীতে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। এছাড়া অনুষ্ঠান বিভাগের দৈন্যদশা এতটাই প্রকট যে এখন আর অনুষ্ঠানসূচী তৈরি হয় না। একদিন আগে ঠিক করা হয় পরদিন কী অনুষ্ঠান প্রচার হবে। ফলে এখন আর টিভি গাইড প্রকাশিত হয় না। এছাড়াও প্রকাশের তাড়নায় প্রায়শই কোন দিবস বা প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ প্রচার করা হয়। এর ফলে একইসঙ্গে জাতির জনকের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার পাশাপাশি দর্শকদের অহেতুক বিড়ম্বনা দেয়া হয়। বার্তা বিভাগের দৈন্য ॥ অনুষ্ঠানের মতো বিটিভির বার্তা বিভাগের অবস্থা আরও করুণ। মূলত স্থায়ীভাবে নিযুক্ত ১৫ জনের বেশি প্রযোজক পদধারী ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করেন বিভাগটিকে। কোন সংবাদ যাবে আর কোনটি যাবে না এটি থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রীর বরাত দিয়ে ভূঁইফোড় সংগঠনের নানা সংবাদ প্রচার করা হয়। অথচ সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকা- প্রচারে বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর চেয়ে অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে বিটিভি। এই বিভাগের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এখানে দীর্ঘদিন কোন নতুন নিয়োগ নেই। বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা এখন কৌশলে সরকারী দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কর্মকা- পরিচালনা করছেন। বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই বিভাগের এক নির্বাহী প্রযোজক সবাইকে ম্যানেজ করে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন। এমনকি বার্তা বিভাগের উপমহাপরিচালক শাহিদা আলমও তার প্রভাবের কাছে অসহায় বলে জানা যায়। উক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে স্যাবোটাজ করারও অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে সংবাদ বিভাগে বিএনপি-জামায়াতপন্থী প্রযোজকরাই এখন আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অনুসারী কিংবা প্রগতিশীল প্রযোজকরা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। জানা যায়, ২০০৭ সালে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হানিফ বার্তা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব নেন এবং পরবর্তীতে তিনি বিটিভির মহাপরিচালক পদেও উন্নীত হন। তাঁর সময়ে দলীয় বিবেচনায় ১১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয় এই বিভাগে। ওরা ১১ জন নামে পরিচিত ওই দলে উল্লেখিত নির্বাহী প্রযোজকও ছিলেন। আর ভ্রান্ত নীতির ও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে সংবাদমাধ্যমে কর্মরত পেশাদার সাংবাদিকরা যুক্ত হতে পারছেন না প্রতিষ্ঠানটিতে। আরেক সমস্যা হচ্ছে এই গণমাধ্যমটিতে আজও প্রতিবেদকদের স্বীকৃতি মেলেনি। বছরের পর বছর ধরে চুক্তিভিত্তিক অতিথি প্রযোজক পদে সংবাদ প্রতিবেদক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিটিভি। ফলে এই প্রতিবেদকরা কর্মক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এই প্রতিবেদকদের বেতন দেয়া হয় শিল্পী সম্মানী খাত থেকে। আর পদ স্থায়ী না হওয়ায় তুচ্ছ কারণে চাকরিচ্যুত হতে হয় প্রতিবেদকদের। চিত্রগ্রাহক বিভাগের নৈরাজ্য ॥ বার্তা বিভাগের মতো চিত্রগ্রাহক বিভাগেও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি এ্যাসাইনমেন্ট যাতে কাভার করা সম্ভব না হয়, এজন্য সহকর্মীর ক্যামেরার ব্যাটারি ও চার্জার গায়েব করেন এক স্থির চিত্রগ্রাহক । এ নিয়ে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই একটি বিভাগীয় মামলা হয় (বিটিভি-স্মারক নং-২৪৪৩/৩০৭৬)। মামলার রায়ে দোষী প্রমাণিত হলেও ওই স্থির চিত্রগ্রাহক বহাল তবিয়তে কাজ করেছেন ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে। দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তা ॥ গণমাধ্যমে কাজের কোন অভিজ্ঞতা নেই এমন আমলাদের বিটিভির মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়াটা দীর্ঘদিনের রেয়াজে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক পদে নিযুক্ত আছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মান্নান। কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি থাকলেও নেই গণমাধ্যম পরিচালনার অভিজ্ঞতা। নেই এ সম্পর্কিত কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিচয়ে অনুষ্ঠান বিভাগের উপমহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন বাহারউদ্দিন খেলন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির সর্বেসর্বা ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। মূল ধারার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি কিছুদিন বার্তা বিভাগের উপমহাপরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। বিটিভির নানা নৈরাজ্য নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক আবদুল মান্নানের সঙ্গে। বিটিভি ক্রমশই দর্শক হারাচ্ছেÑএ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে জনকণ্ঠকে বলেন, দর্শক কমার কারণ নেই। কারণ, বহুমাত্রিক অনুষ্ঠান করে থাকে বিটিভি। শহরের কতজন লোক টিভি দেখে? গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঠিকই বিটিভি দেখে। মাঝে মাঝেই বিটিভির পদা ঝাপসা হয়ে যাওয়া কিংবা শব্দ ভেঙ্গে যাওয়াসহ কারিগরি ত্রুটির বিষয়ে বলেন, এটা আসলে যেসব এলাকায় ঘটে সেখানকার কেবল অপারেটরদের কোন দুর্বলতার কারণে ঘটে থাকে। নিয়োগবিধিতে ত্রুটি আছে বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, এটি সংশোধনের প্রক্রিয়ায় আছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে অনুষ্ঠান করা প্রসঙ্গে বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাহারউদ্দিন খেলনের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যা। জানা যায়, বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ॥ বিটিভিতে নানা রকম নৈরাজ্যের বিষয়টি স্বীকার করে নেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এ প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এক দিনেই এমনটা ঘটেনি। এটা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটিতে এমন আবর্জনা জমেছে। নতুনভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দক্ষ ও যোগ্য জনবলের অভাবেই প্রতিষ্ঠানটির এমন বেহাল দশা হয়েছে। সেই অভাব মেটাতে নতুন করে প্রায় দেড় শ’ দক্ষ জনশক্তি বিটিভিতে নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত কর্মতৎপরতা চলছে। বিটিভির নিয়োগবিধি সংশোধন প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এই বিধিমালার বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগবিধি ও ঢালাও পদোন্নতি ॥ সামগ্রিকভাবে বিটিভির মানোন্নয়নের বড় অন্তরায় হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগবিধি। সরকার বা তথ্য মন্ত্রণালয় প্রণীয় নয়, বরং প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৈরি নিয়োগবিধি অনুযায়ী চলে কর্মকা-। আর এই নিয়োগবিধি অনুযায়ী সরাসরি নিয়োগের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গণহারে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে পদোন্নতি দেয়ার মতো অবশিষ্ট কোন কর্মকর্তা নেই। আর এই প্রক্রিয়া অনুসরণের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষিত ও যোগ্য কর্মকর্তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সর্বশেষ ২০১০ সালে প্রকাশিত ১৬৯ কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠ তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্নাতক পাস করেননি এমন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার সংখ্যা কমপক্ষে ১৫ জন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি কেন্দ্র ও ১৪টি উপকেন্দ্রসহ রামপুরার প্রধান কার্যালয়ে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত বিটিভির অনুমোদিত পদসংখ্যা এক হাজার ৬৬৭টি। এর মধ্যে ৪০৪টি পদ শূন্য রয়েছে এবং এদের ১৫২ জনই প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। ২০০৯ সাল থেকে বিটিভিতে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ম. হামিদ বলেন, বিটিভির সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগবিধি। এটা বদলানো ছাড়া উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। সৃজনশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়াটাও এখানে ত্রুটিপূর্ণ। নিয়োগবিধি অনুসারে কেউ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এগিয়ে থাকলে তার যোগ্যতার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। আমলানির্ভরতা ॥ বিটিভির আরেক সমস্যা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিকতা। অধিকাংশ সময় সৃজনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কহীন আমলাদের দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটিভির বার্তা, প্রশাসন ও অর্থবিষয়ক কর্মকা- মূলত আমলারাই পরিচালনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বিটিভিতে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে তথ্য ক্যাডার তিনজন এবং চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চারজন এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি সবাই ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। মাধ্যমটিতে মহাপরিচালক থেকে ব্যবস্থাপক পর্যন্ত তিন ডজন পদে নিজস্ব কর্মকর্তা আছেন পাঁচ থেকে ছয়জন। বাকিরা অতিরিক্ত দায়িতে কিংবা প্রেষণে বা পদোন্নতি পেয়ে এসেছেন। বিশিষ্টজনদের অভিমত ॥ বিটিভির এমন অবস্থার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে অতিমাত্রায় সরকারীকরণকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। তাঁরা বলছেন, মূলত স্বৈরশাসক এরশাদের আমল থেকেই বিটিভি পুরো মাত্রায় সরকারীশাসিত হয়ে পড়ে। এরপর প্রতিটি সরকারের আমলেই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে চলেছে এক ধরনের দলবাজি। সৃজনশীলতার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই এমন আমলাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে মেধাশূন্য মানুষের অভাবে ক্রমশই অবনতি ঘটেছে সরকারী এই টিভি চ্যানেলটির। এক দশক আগেও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও বর্তমানে এটা পরিণত হয়েছে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। অথচ সমস্যার উত্তরণে নেয়া হচ্ছে না কোন উদ্যোগ। সাবেক আইটিআই সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, সব সময়ই সরকার যেভাবে চালাতে চায় সেভাবেই চলে বিটিভি। অথচ স্বায়ত্তশাসন ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে কেউ ভাল কিছু করতে চাইলেও নেই স্বাধীনতা। বড় বাধা হচ্ছে এখানে নিযুক্ত স্থায়ী সরকারী কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন চায় না। এর মাধ্যমে নিজেদের অদক্ষতাকে আড়াল করে রাখতে চায়। অন্যদিকে কোন সরকারই বিটিভিকে নিজের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে চায় না। সংবাদের গ্রহণযোগ্য কমে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করার বিষয়টি মেনে নেয়া যায়। কিন্তু যে কোন মন্ত্রীর অগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের খবরও প্রতিনিয়ত ফলাও করে প্রচার করা হয়। দেখা যায়, একই বুলেটিনে তথ্যমন্ত্রীর তিনটি সংবাদ প্রচার হচ্ছে। ফলে সংবাদ প্রচারে বস্তুনিষ্ঠতা ও গ্রহণযোগ্যতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। মানুষ যখন প্রাইভেট চ্যানেলে খবর দেখে তখন তারা পার্থক্যটা বুঝতে পারে। এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী ও নাট্য নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, বিটিভির অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে মনে হয়, ওখানে মাথা খাটানোর মতো লোক নেই। একদিকে রয়েছে সরকারশাসিত ব্যবস্থা, অন্যদিকে যুক্ত হয়েছে আমলাতান্ত্রিকতা। টেলিভিশন বা অন্য কোন মাধ্যমের সৃজনশীল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই এমন ব্যক্তিরা পরিচালনা করছেন প্রতিষ্ঠানটি। অথচ বিটিভির সোনালি সময়ে বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, খ্যাতিমান নাট্য নির্দেশক ও অভিনয়শিল্পী আবদুল্লাহ আল মামুন, প্রখ্যাত নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরীর মতো সৃজনশীল ব্যক্তি অনুষ্ঠান বিভাগে কাজ করেছেন। তখন ভাল অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য সৃজনশীল মানুষদের খুঁজে এনে এখানে পদায়ন করা হতো। এখন ঘটছে তার উল্টোটা। সৃজনহীন ব্যক্তিরা জড়িত হয়েছেন সৃজনশীল কাজে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অভিনেতা ও প্রযোজক তারিক আনাম খান বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সৃষ্টিশীল মানুষ। বিটিভির সুসময়ে তেমন ব্যক্তিরাই সম্পৃক্ত ছিলেন আপামর মানুষের কাছের এই গণমাধ্যমটির পরিচালনার সঙ্গে। এখন আর সেই অবস্থা নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমলা দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। ফলে মেধাসম্পন্ন মানুষরা যুক্ত হচ্ছেন না প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। আর মেধাহীন মানুষ দিয়ে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। আরেকদিকে যে সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে তারাই যেন দখল নিয়েছে বিটিভি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির মান। ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে জামিল চৌধুরীর মতো গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব একসময় বিটিভির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী ও নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো মেধাবী মানুষরা এই বিভাগে কাজ করেছেন। কবি শহীদ কাদরি, শিল্পী এমদাদ হোসেনরাও কাজ করেছেন এই প্রতিষ্ঠানে। অবস্থার উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাজটি কঠিন হলেও সবার আগে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে মেধাবী মানুষদের। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হলে পুরো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। দর্শকের ভাষ্য ॥ এক সময় নিয়মিত বিটিভি দেখতেন পুরনো ঢাকার সূত্রপুরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন। বর্তমানে অবসর জীবন কাটানো এই দর্শক বলেন, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিটিভি দেখে অনেক বিনোদন পেয়েছি। তখন দারুণ বৈচিত্র্যময় ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালা। আজও মনে দাগ কেটে আছে ফজলে লোহানী উপস্থাপিত ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানটি। এদেশে এত চমৎকার অনুষ্ঠান আমি খুব কম দেখেছি। শহীদুল্লা কায়সার রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত সংশপ্তক নাটকটিকে এখনও কালজয়ী মনে হয়। ইডিয়টস, দূরবীন, মাটির কোলে, সকাল সন্ধ্যা কিংবা গ্রন্থিকগণ কহের মতো নাটক আজও বিষয়বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল। অথচ এখন আর বিটিভিতে ইত্যাদি ছাড়া তেমন কোন ভাল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বা বিষয়বস্তুনির্ভর নাটক খুঁজে পাই না।
×