ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ফুরফুরা শরীফের দাদা হুযূর কিবলা

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৩ মার্চ ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ফুরফুরা শরীফের দাদা  হুযূর কিবলা

ফুরফুরা শরীফের দাদা হুযূর কিবলা হযরত মওলানা শাহ্ সূফী মুজাদ্দিদী যামান আবূ বকর সিদ্দীকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন নিখিল বাংলা আসামের সর্বশ্রেষ্ঠ পীর ও ওলীকুল শিরোমণি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী-জনতার মহাবিপ্লবের কয়েক বছর আগে পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলার ফুরফুরা নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত এবং ঐতিহ্যবাহী সিদ্দীকী খান্দানে। এই খান্দান ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হুর বংশ ধারার স্মৃতি বহন করে আসছে। এই খান্দানের এক পূর্ব পুরুষ হযরত মানসুর বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি সুলতানী আমলে পরিচালিত এক যুদ্ধাভিযানের তদানীন্তন বাঙালা মুলকে আগমন করেন। এক যুদ্ধে বালিয়াবাসন্তীর অত্যাচারী সামন্ত প্রভু পরাজিত হন। এই যুদ্ধে বালিয়াবাসন্তীর পতন হলে এক আনন্দ জোয়ার প্রবাহিত হয়। বালিয়াবাসন্তীর নামকরণ হয় ফুরফুরা যার অর্থ আনন্দমুখর স্থান। এই সিদ্দীকী খান্দানের ষষ্ঠ পুরুষ হযরত মুস্তফা মাদানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর পুত্র হযরত মাসুম রব্বানী (রহ.)-এর মুরীদ ও খলীফা ছিলেন। এই মুস্তফা মাদানীর নামে জনপদের নামকরণ হয় মাদানীপুর যা এখন মেদেনীপুর নামে পরিচিত। হযরত দাদা হুযূর কিবলার আব্বা হাজী আবদুল মুকতাদির দাদা হুযূর কিবলার ৯ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর আম্মাজান মুহব্বতুন্ নিসা শিশুপুত্রকে বড় করে তোলেন। দাদা হুযূর কিবলা মায়ের তত্ত্বাবধানে বড় হন। পড়াশোনা করেন সীতাপুরে নবাব আলিবর্দি খান প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়। পরে তিনি হুগলী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে তদানীন্তন মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি মদীনা মনওয়ারা থেকে হাদীসের ৪০ খানা কিতাবের সনদপ্রাপ্ত হন। তিনি হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলবী (রহ.)-এর খাস্ খলীফা মওলানা হাফেজ জামালুদ্দিন (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে হাদীস শরীফ ও তফসীরে কুরআনের উচ্চতর তা’লীম প্রাপ্ত হন। এ ছাড়াও হযরত মওলানা বিলায়েত (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে মনতিক ও হিকমা বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ইলম হাসিল করেন। ইলমের নানা শাখায় পূর্ণ ইলম হাসিল করার পর তিনি হযরত সুফী ফতেহ আলী ওয়ারসী (রহ.)-এর নিকট মুরীদ হয়ে ইলমে তাসাওউফ সমস্ত তরীকার সবক গ্রহণ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কাদিরীয়া, চিশতীয়া, নক্সবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া আওর মুহম্মাদীয়া তরীকার সনদ ও খিলাফতনামা প্রাপ্ত হন। বাংলার মুসলিম সমাজের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন। মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকার সংস্কারের জন্য তিনি দাবি তোলেন। যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করতে তিনি মুসলমানদের উৎসাহিত করেন। তাঁর উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৮০০ মাদ্রাসা ও ১১০০ মসজিদ স্থাপিত হয়। তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সম্মানিত সদস্য হন। তিনি অনেক সংগঠন গড়ে তোলেন। যেমন, আঞ্জুমানে ওয়ায়েজীন, জমিয়াতে ওলামায়ে বাংলা, আসাম ইত্যাদি। জমিয়াতে ওলামায়ে বাংলা আসামের সভাপতি হিসেবে তিনি সৌদি আরবের বাদশাহ্্ আবদুল আজিজ ইবনে সউদকে পত্র পাঠান। সেই পত্রে তিনি সৌদি আরবে শরীয়তবিরোধী কার্যাদি রোধ করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম সম্পাদিত কোন বাংলা পত্রিকা না থাকায় দেশে মুসলমানদের কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারছে না। তাঁর উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের বলিষ্ঠ দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক মিহির সুধাকর পত্রিকা, নবনুর পত্রিকা, সাপ্তাহিক মোহাম্মদি, মাসিক মোহাম্মদি পত্রিকা, সাপ্তাহিক সোলতান যা পরবর্র্তীকালে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়, মাসিক ইসলাম দর্শন পত্রিকা, সাপ্তাহিক হানাফি, মাসিক শরীয়তি ইসলাম প্রভৃতি। সারা বাংলায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত অনেক ইসালে সওয়াব মহফিল আজও রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৪ মাঘ দ্বারিয়াপুর শরীফে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল অন্যতম। আজও ফুরফুরা শরীফে ফাল্গুন মাসের ২১, ২২, ২৩ তারিখে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল অনুষ্ঠিত হয়। তিনি তাঁর অসিয়তনামায় বলেছেন : আমার মতে, যাবতীয় চাকরির উপযুক্ত বিদ্যাশিক্ষায় কোন বাধা নেই। যে চাকরি শরীয়ত অনুযায়ী জায়েজ তা করবে। কিন্তু হালাল উপার্জন ও সুন্নাত মোতাবিক পোশাক ইত্যাদি ও রোজা নামাজ ঈমান ঠিক রেখে করবে। তিনি বলেছেন : মেয়ের সাচকের (পণের) টাকা খাবে না। যে ব্যক্তি খাবে তদদ্বারা জিয়াফত করবে তা হারাম। এই জিয়াফত যারা খাবে তাদের হারাম খাওয়ার গুনাহ হবে। তিনি বলেছেন : তাই ভগ্নি ও অংশীদারদের অংশ ফারায়েজ অনুযায়ী ভাগ করে দেবে। যদি তাদের দেয়া অসম্ভব হয় তবে মূল্য দেয়া হোক বা যে কোন প্রকারে হোক সন্তুষ্ট করে দাবি ছাড়ায়ে নেবে। তা না করলে আল্লাহ্্র নিকট দায়ী থাকবে। আলেম সাহেবদের নিকট আমার বিনীত আরজ এই যে, আপনাদের মধ্যে যদি কোন মাসলা নিয়ে এখতিলাফ বা মতভেদ হয় তবে একত্রে বসিয়া কিতাবসমূহ নিয়ে মতভেদ মীমাংসা করে সর্বসাধারণের নিকট সহীহ্ মতপ্রকাশ করবেন। আলেম সমাজে দলাদলি থাকলে অচিরেই সমাজ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি আরও বলেন : আমার বাড়িতে বছরের ২১, ২২, ২৩ ফাল্গুন তারিখ নির্ধারণ করে একটি ওয়াজের মহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এই মহফিল যাতে আল্লাহ কায়েম রাখেন তার চেষ্টা আমার পুত্রগণ, খলিফাগণ ও মুরীদগণ করবেন। আমার খলিফাগণের মধ্যে যদি কারও বাড়িতে এরূপ মহফিল করতে সামর্থ্য থাকে তাহলে তিনি তা করবেন। কিন্তু সাবধান! কেউ যেন অর্থের লোভে বা অন্য কোনরূপ মানমর্যাদার জন্য না করেন। জনাব দাদা হুযূর কিবলার খাস্্ খলীফা ছিলেন বর্তমান লেখকের আব্বা হুযূর কিবলা। এছাড়াও তাঁর প্রায় ৩শ’ খলীফা ছিলেন যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর ৫ পুত্র হযরত বড় হুযূর কিবলা, মেঝো হুযূর কিবলা, সেঝো হুযূর কিবলা, নোয়া হুযূর কিবলা, ছোট হুযূর কিবলা, মওলানা নিছারউদ্দিন আহমদ, মওলানা রুহুল আমীন, মওলানা খান বাহাদুর আহমদ আলী, মওলানা ময়েজুদ্দিন হামিদী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে অসংখ্য গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য সকলকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি যিকির করাকালে বাংলা ভাষায় তালিম দিতেন। এমনকি মুরীদ করতেন বাংলা ভাষায়, তওবা পড়াতেন বাংলা ভাষায়। তিনি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ শুক্রবার সুবহে সাদিক ওয়াক্তে ফুরফুরা শরীফের নিজ হুযরা খানায় প্রায় ৯৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ আজাদ পত্রিকায় দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে লেখেন : মওলানা আবু বকর সাহেবের ইন্তেকালে অন্তত অর্ধশতাব্দীব্যাপী একটা কর্মজীবনের ও ধর্ম সাধনার অবসান ঘটিল। ... তাঁহার কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিকের অসাধারণ তৎপরতার পরিচয় দিতে যাওয়া আজ আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাঁহার অমায়িক ব্যবহার, তাঁহার অসাধারণ আখলাক এবং আমাদের প্রতি তাঁহার অশেষ স্নেহের বর্ণনা করিতে যাওয়ার আজ আমাদের সাধ্যাতীত। তাঁহার লাখ লাখ মুরীদ ও গুণমুগ্ধ ভক্তের ন্যায় আমরাও আজ এই বিরাট অসাধারণ ব্যক্তিত্বের তিরোধানে শোকে অভিভূত। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×