ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

২০১৪-১৫ অর্থবছরের সূচক স্থিতিশীল

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৩ মার্চ ২০১৫

২০১৪-১৫ অর্থবছরের সূচক স্থিতিশীল

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত রবিবার সংসদে অর্থনীতির ছয় মাসের অগ্রগতির একটা খতিয়ান পেশ করেছেন। এতে অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সূচকগুলো হলো- সরকারের কর রাজস্ব, রাজস্ব ব্যয়, এডিপি বা উন্নয়ন ব্যয়, রফতানি আয়, আমদানি ব্যয়, বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ, রেমিট্যান্স আয়, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি। এই নয়টি সূচক আমাদের কাছে পরিচিত। এগুলো ধরেই সাধারণত আলোচনা করা হয় এবং অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এর থেকে অনেকাংশে বোঝা যায়। এক কথায় যদি বলি তাহলে বলতেই হয়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস মোটামুটি ভালই গেছে। প্রথম ছয় মাস মানে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। বলা হয়, রাজনৈতিক আন্দোলনের বকলমে নাশকতা ও সহিংসতার কাজ শুরু ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে আজ অবধি সময়ের হিসাব এতে নেই। না থাকলেও বলা যায়, অর্থনীতি সার্বিকভাবে এতসব নাশকতা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত যথেষ্ট শক্তি দেখিয়ে চলেছে। তবে এই শক্তি কতদিন অব্যাহত থাকবে তা বলা যাবে কিছুদিন পরে। আপাতত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের হিসাবে পরিস্থিতি যথেষ্ট অনুকূলই মনে হচ্ছে। যদি আমরা মূল্যস্ফীতির কথাই ধরি তাহলে দেখা যাবে এর হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এবং এক বছরে যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার এক শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে। এটা অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের অন্যতম লক্ষণ। তবে একটা কথা আছেÑ মূল্যস্ফীতি ঠিক রেখে উন্নয়ন ঘটানোর কারিগরিই হচ্ছে আসল কারিগরি। আমাদের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ছয় হতে সাড়ে ছয় শতাংশে আটকা পড়ে আছে। ঋণ সম্প্রসারণও আশানুরূপ নয়। এমতাবস্থায় শুধু কম মূল্যস্ফীতির হারই আমাদের কেবল বিচার্য বিষয় হতে পারে না। তবে এ কথা ঠিক, মূল্যস্ফীতি ঠিক থাকলে গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত একটু স্বস্তিতে থাকে। দারিদ্র্যসীমার কিছুটা উপরের লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নামে না। এটা নিম্ন মূল্যস্ফীতির একটা বড় লাভ। দেখা যাচ্ছে, যদিও মূল ভিত্তিটা ঠিক আছে তথাপি ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা যাবে না বর্তমান নাশকতা ও সহিংসতার জন্য। এটা আমাদের জন্য খারাপ খবর। কারণ আমরা ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের টার্গেট সামনে রেখে কাজ করছি। মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করছি। সেই অবস্থায় এক মাস, দুই মাস, তিন মাস সময় নষ্ট হওয়া মানেই অগ্রগতি পিছিয়ে যাওয়া। আবার ‘জিডিপি’র গতি শ্লথ হলে সবকিছু শ্লথ হয়ে পড়ে, যদিও মূল ভিত্তিটা মোটামুটি ঠিক থাকে। যেমন সরকারের রাজস্ব আয়। রাজস্ব আয় বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম এবং কম হওয়ারই কথা। অর্থাৎ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু আমরা যে গতিতে তা বৃদ্ধি পাক চেয়েছিলাম সেই তুলনায় হচ্ছে না। তবে আমার কথা, রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পায়নি যা বরাবর হয়। বরাবর দেখা যায়, আয় যেমন বাড়ে তেমনি বাড়ে রাজস্ব ব্যয়। অনেক সময় বরং ব্যয় বাড়ে বেশি গতিতে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের রাজস্ব ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। দৃশ্যত ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু সম্ভবত এটা ঘটেছে কয়েকটা কারণে। তেলের দাম কম। আন্তর্জাতিক বাজারে কম। এর একটা ফল আমরা পাচ্ছি। যদিও সাধারণ ভোক্তারা সরাসরি কর্মফল পায় না। সরকারের ভর্তুকি খরচ কম। তেলের দাম বেশি হলে সরকারকে বিদ্যুত এবং তেলে ভর্তুকি দিতে হয়। এবার তা হচ্ছে না বলেই খবর। এতে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় কম হওয়ারই কথা। ভর্তুকি বেশি হলে পেট্রোলিয়াম সংস্থাকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। এতে এদের সুদ ব্যয় বাড়ে যা খোদ সরকারের ঘাড়ে পড়ে। এবার এসব খাতে সরকারের খরচ কম। এ কারণে সরকার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনেকটা সুবিধা পাবে বলে আমি মনে করি। বাজেট ঘাটতি কম হবে। সরকারের ঋণও কিছুটা কমার কথা। অবশ্য বিষয়টা বোঝা যাবে বছর শেষে। আগেই বলেছি বছরটি অস্বাভাবিকভাবে কাটছে। জানুয়ারি থেকে ব্যবসাবাণিজ্য বিঘিœত হচ্ছে। পরিবহন, পর্যটন, কৃষি সরাসরি আক্রান্ত। আমদানি ও রফতানি ব্যবসাও আক্রান্ত, যার হিসাবটা এখন থেকে পাওয়া যাবে। আপাতত দেখা যাচ্ছে, রফতানি যেমন বেড়েছে আমদানিও বেড়েছে। তবে যথারীতি আমদানি ব্যয় বেড়েছে খুবই বেশি হারে। প্রথম ছয় মাসে আমদানি ব্যয় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন। বিপরীতে রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র দেড় শতাংশ হারে। যদিও বেড়েছে তবুও বলা যায়, এই হার অব্যাহত থাকলে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রামাফিক আমদানি-রফতানি হবে না। না হওয়া মানে শুল্ক আয় কম হওয়া। কারণ আমদানি ও রফতানির ওপরই নির্ভর করে শুল্ক আয়। আর শুধু শুল্ক আয়ের কথা বলি কেন, এর ফলে ভ্যাট ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমার ধারণা। এদিকে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) খরচবিষয়ক তথ্যে বলা হয়েছে, প্রথম ছয় মাসে পূর্ববর্তী একই সময়ের তুলনায় এডিপি ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশের উপরে। দৃশ্যত ভাল খরব। এডিপি মানে উন্নয়ন ব্যয়। উন্নয়ন ব্যয়ের গতি বাড়লে এটা ভাল খবর। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে এডিপি ব্যয় ঠিক রাখা যাবে না। ইতোমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সরকার কম করে হলেও ১০ শতাংশ হারে এডিপি কাটছাঁট করবে। দৃশ্যতই এটা বর্তমান রাজনৈতিক কারণে। যে কারণেই হোক এটি আমাদের জন্য দুঃসংবাদ। কারণ বছর শেষে চুম্বক কথা হচ্ছে উন্নয়ন কতটুকু হলো। রাজস্ব বাজেট কাটছাঁট আর এডিপি কাটছাঁট এক কথা নয়। সকল বাজেটের শেষ কথা উন্নয়ন বা এডিপি। সেটাই যদি কাটছাঁট করতে হয় তাহলে তা সুখবর হয় না। বোঝাই যাচ্ছে, বর্তমান সহিংস পরিস্থিতিতে এডিপি ঠিক রাখা এক সুকঠিন ব্যাপার। এই অবস্থার মধ্যেও সুখবর হচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। রেমিট্যান্স প্রবাহে কোন ঘাটতি নেই। দরিদ্র কৃষকের ছেলেমেয়েরা এ বছরের প্রথম ছয় মাসে সাড়ে ১০ শতাংশ রেমিটেন্স বেশি পাঠিয়েছে দেশে। গত বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পেয়েছিল সাড়ে ৮ শতাংশ হারে। যেখানে পূর্ববর্তী বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পেয়েছিল সেখানে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সুখবর। এর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আরেকটি সুখবর। সেটি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ খবর এর পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার। এটা বাংলাদেশের রেকর্ড। কারণ অনেক। এসবে যাব না। ঘটনা হচ্ছে যেখানে তিন-চার মাসের আমদানির সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকলেই হতো, সেখানে এই মুহূর্তে আমাদের আছে ৭-৮ মাসের। এটা অর্থনীতির সাবালকত্বের প্রমাণ। এর ফলে ডলারের দাম নিচের দিকে স্থিতিশীল। বলা যায়, পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায়ও আমাদের ডলার-টাকা সম্পর্ক অনেক বেশি স্থিতিশীল। এতে অর্থনীতিতে একটা স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে। একটা উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করাই যায়। অর্থমন্ত্রী সংসদে যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তাতে দেখা যায়, বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ আলোচ্য ছয় মাসে বেড়েছে মাত্র ৭ শতাংশ হারে। এটা নিঃসন্দেহে কম। বেসরকারী খাত হচ্ছে এখন বিনিয়োগের প্রধান বাহন। এখানে বিনিয়োগ বাড়া মানেই ঋণের প্রবাহ বাড়া। ব্যাংক ঋণ দেয়। ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে। ঋণ বেশি না বাড়া মানে ব্যবসায়ীর পুঁজি কম বিনিয়োগ হওয়া। এই বিষয়টি এই মুহূর্তে একটা খারাপ খবর। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
×